নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের যুবক মশিউর রহমান। নিজের ছাদবাগানে সংগ্রহ করেছেন প্রায় এক শ ধরনের পর্তুলিকা। সারা দেশের সংগ্রাহকদের মধ্যে সেসব পর্তুলিকা বিলিয়ে দিচ্ছেন বিনা মূল্যে। সব প্রাণীর জন্য বাসযোগ্য সমাজ গড়তে গ্রামের ফাঁকা জায়গায় নিজ উদ্যোগে রোপণ করেছেন হাজারো ফলদ গাছ।
জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার মিরকুটির ছেও গ্রামের মকবুল হোসেনের সন্তান মশিউর রহমান। একটি বেসরকারি কলেজের তড়িৎ প্রকৌশলের শিক্ষক তিনি। প্রকৃতি রক্ষায় নানান কাজের পাশাপাশি বসতবাড়ির ছাদে চমৎকার এক বাগান গড়ে তুলেছেন। সেই বাগানে ঠাঁই পেয়েছে নানান রঙের পর্তুলিকা।
পর্তুলিকার রাজত্ব
দোতলা ভবনের ছাদজুড়ে সারি সারি টব। আপেল, কমলা, ব্লু ডেইজ, অর্কিড, শাপলা, এমারলিস লিলি, গোলমরিচ, চুইঝাল, চন্দন, এলাচি, আলু বোখারাসহ নানান জাতের প্রায় ৫০০ গাছ মাথা উঁচু করে আছে এসব টবে। চার বছর ধরে মশিউর তাঁর বাড়ির ছাদে এই বাগান গড়ে তুলেছেন। ছাদের এক পাশে ককশিটের তৈরি টবে হাজারো ছোট ছোট ফুল। সবুজ লতানো ঘাসের বুকে যেন লাল, গোলাপি, সাদা, খয়েরি, বেগুনির মতো অজস্র রঙের মেলা বসেছে। মুখভর্তি হাসি নিয়ে মশিউর পরিচয় করিয়ে দেন, ‘এই আমার পর্তুলিকার রাজত্ব’। পার্সোলিন, ডায়মন্ড রিং, মসরোজ, জায়ান্ট ও টায়রা প্রজাতির প্রায় ৯৮ ধরনের পর্তুলিকা মশিউরের রাজত্বে। তিন বছর আগে শখের বশে পর্তুলিকা সংগ্রহ শুরু হলেও বর্তমানে তা নেশায় পরিণত হয়েছে। থাইল্যান্ড থেকে ৬০ ধরনের পর্তুলিকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন সংগ্রাহকের কাছ থেকে নিয়েছেন আরও ৩৮ ধরনের পর্তুলিকা। এসব সংগ্রহ করতে গিয়ে শুরুতে পরিবারের বাধার মুখে পড়লেও এখন তাদের কাছেই সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পান তিনি।
পরিবেশ রক্ষার হাতিয়ার
ছেলেবেলা থেকেই প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে মশিউরকে চেনেন আশপাশের লোকজন। তবে পর্তুলিকার বড় সংগ্রাহক হিসেবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে চেনেন সবাই। মশিউর বলেন, ‘দেশের প্রায় দুই হাজার মানুষকে বিনা মূল্যে পর্তুলিকা দিয়েছি। এতে দেশব্যাপী একটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে। মানুষের মনে সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা থেকে পর্তুলিকা বিলানো শুরু করলেও এই পর্তুলিকা এখন আমার পরিবেশ রক্ষার হাতিয়ার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বন্ধুদের সামাজিক বনায়নে অর্থায়নের আহ্বান জানাচ্ছি। পরিচিতির কারণে তারা আমার আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে। এভাবে অর্থ সংগ্রহ করে গত বর্ষায় গ্রামের বিভিন্ন সড়কের পাশে প্রায় এক হাজার ফলের গাছ লাগিয়েছি।’
আয়ের পথ
স্নাতক শেষে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে হবিগঞ্জ চলে যান মশিউর। তখন বাগান ও পর্তুলিকা দেখাশোনার দায়িত্ব নেন তাঁর ছোট ভাই মেহেদী হাসান। রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মেহেদী সে সময় থেকেই পর্তুলিকা বিক্রি শুরু করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মেহেদি জানান, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই অনেক কিছু বিক্রি করে। ভাইয়ার সংগ্রহ থেকে আমিও পর্তুলিকা বিক্রি শুরু করি। প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার পর্তুলিকা বিক্রি করেছি।’
এদিকে চাকরিতে মন টেকেনি মশিউরের। নিজের বাগানের টানে আবারও গ্রামে ফিরে আসেন। অনেকেই বাড়তি আয়ের জন্য পর্তুলিকা বিক্রি করছেন বলে জানান মশিউর। তাঁদের মধ্যে গৃহিণীরা এগিয়ে। পর্তুলিকা চাষকে পেশা হিসেবে নেওয়া সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
গড়তে চান বাসযোগ্য সমাজ
মশিউরের বারান্দায় আসা পাখিদের জন্য খাবার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা রেখেছেন তিনি। পশুপাখির বাসস্থান ও খাবার জোগানের জন্য গ্রামের ফাঁকা জায়গা ও সড়কের পাশে কয়েক হাজার ফলদ গাছ রোপণ করেছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েক শ তালের আঁটি সংগ্রহ করেছেন সড়কের পাশে রোপণের জন্য। গ্রামের যুবকদের সঙ্গে মিলে সড়কের পাশে রোপণ করেছেন শত শত সুপারিগাছ। মশিউর মনে করেন, মানুষের মতো অন্যান্য পশুপাখি, কীটপতঙ্গেরও এই সমাজে সমান অধিকার আছে। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে মানুষ নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংস করছে। ফলে পরিবেশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পোকামাকড় ও পশুপাখি হারিয়ে যাচ্ছে। বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে পৃথিবী। মানুষের যৌথ প্রচেষ্টায় সমাজকে সব প্রাণের জন্য বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব বলে বিশ্বাস মশিউরের।