নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার জোয়ানপুর বেলপুকুর গ্রামের বাসিন্দা রাজমনি পাহান। পাপোশ বানিয়ে দরিদ্র দশা থেকে সচ্ছলতার দেখা পাওয়া এই নারী বলেন, ‘আগে বর্ষালি (আমন ধান) ও ইরির সময় ধান লাগানো (চারা রোপণ) এবং কাটার সময় ছাড়া বছরের ছয়-সাত মাসই হামাগের কাজ থাকত না। টাকা না থাকায় বাজার-সদাই করতে প্যারতু না হামরা। ছ্যালে-পুলে লিয়ে খুব কষ্ট করে জীবন কাটিতো। পাপোশ তৈরির কাজ শিখে হামাগের অভাব ম্যালাখানি দূর হছে।’
শুধু রাজমনি পাহান নন, তাঁর মতো সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকাংশ নারীর একসময় শুধু কৃষিকাজ করে জীবন চলত। বছরের ছয়-সাত মাস ঘরের কাজ ছাড়া আর কিছু করার থাকত না তাঁদের। তবে গত তিন-চার বছরে পাল্টে গেছে সেই অবস্থা। সংসারের অন্যান্য কাজ সেরে এখন তাঁরা সারা বছরই পাপোশ বানানোর কাজ করেন। এতে বাড়তি আয় হচ্ছে তাঁদের। সংসারে আসছে সচ্ছলতা। নওগাঁর মহাদেবপুর ও পত্নীতলা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের হাত ধরে এই বদল এসেছে।
মহাদেবপুর উপজেলার জোয়ানপুর, মগলিসপুর, স্বরূপপুর, এনায়েতপুর, ঋষিপাড়া ওঁরাওপাড়া এবং পত্নীতলা উপজেলার হাসানবেগপুর ও দক্ষিণ কাশপুরসহ বেশ কিছু গ্রামের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা এ কাজে যুক্ত। চার বছর আগে মহাদেবপুরের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ১০-১২ নারীকে প্রশিক্ষণ দেয় আরকো নামের স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা পাপোশ বানানো শুরু করেন। পরে তাঁদের কাছ থেকে শিখে আরও অনেকে এ কাজে যুক্ত হন। এভাবে আশপাশের গ্রামে পাপোশ বানানোর উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়ে।
আরকো বিদেশি উন্নয়ন সংস্থা হেকস-ইপারের সহায়তা নিয়ে নওগাঁর মহাদেবপুর ও পত্নীতলা উপজেলার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৬৫ নারীকে পাপোশ তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রদেশ ভট্টাচার্য বলেন, প্রশিক্ষণ পাওয়া ৬৫ নারীর কাছ থেকে কাজ শিখে বর্তমানে ওই দুই উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাপোশ তৈরির কাজে সম্পৃক্ত আছেন প্রায় এক হাজার নারী।
সম্প্রতি এক বিকেলে রাজমনি পাহানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর বাড়ির উঠানে চারজন নারী বিশেষ কৌশলে সুতার গুটি তৈরি করছেন। বাড়ির বারান্দায় বসানো একটি যন্ত্রে নানা রঙের সুতা দিয়ে পাপোশ তৈরি করছেন রাজমনি ও আরেক নারী। একই চিত্র দেখা গেল ওই গ্রামের ফাল্গুনী পাহান, কল্পনা ওঁরাও, আরতি পাহানসহ অনেকের বাড়িতে।
পাপোশ তৈরির কাজে সম্পৃক্ত এসব নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজার থেকে সুতা কিনে আনা থেকে শুরু করে পাপোশ তৈরির পুরো কাজ তাঁরা নিজেরাই করেন। ঘরের কাজ শেষ করে অবসর সময়ে কিংবা কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই কাজ করতে পারেন তাঁরা। তাই আলাদা করে সময় বের করতে হয় না। একজন নারী দিনে তিন থেকে চারটি পাপোশ তৈরি করতে পারেন। সুতা কেনার খরচ বাদ দিয়ে প্রতিটি পাপোশ বিক্রি করে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা লাভ থাকে। দিনে একজন নারী তিনটি পাপোশ তৈরি করলে তাঁর আয় হয় ১২০ টাকা। এই হিসাবে প্রতি সপ্তাহে পাপোশ বিক্রি করে তাঁর ন্যূনতম আয় হয় ৮৪০ টাকা। মাসে একজন নারীর তিন হাজার টাকার বেশি আয় হয়।
মহাদেবপুরের স্বরূপপুর গ্রামের তিন সন্তানের মা বাসন্তী পাহান (৪৫)। সরকারি একটি পুকুর পাড়ে মাটির তৈরি দুটি ঘরে স্বামী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর বসবাস। ওই বাড়ির বারান্দায় মেশিন বসিয়ে পাপোশ তৈরি করেন তিনি। তাঁর ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করে। পাপোশ বিক্রির আয় ও স্বামীর কৃষিকাজ থেকে যে উপার্জন হয়, তা দিয়ে তাঁর সংসার ভালোভাবেই চলে। তিনি বলেন, ‘পাপোশ বানানোর কাজ শুরুর আগে নুন আনতে পান্তা ফুরাতো তাঁর সংসারে। সপ্তাহে একদিন হয়তো তরকারি রান্না হতো। অধিকাংশ দিনই লবণ দিয়ে ভাত খেতে হতো তাঁদের।’
জোয়ানপুর পূর্বপাড়ার কল্পনা ওঁরাও বলেন, প্রথম দিকে পাপোশ বিক্রির জন্য ক্রেতা খুব একটা পাওয়া যেত না। কিন্তু এখন নওগাঁ শহর ও বগুড়ার সান্তাহার থেকে অনেক ব্যবসায়ী বাড়িতে এসে পাপোশ কিনে নিয়ে যান।
এ বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ মহিলা কল্যাণ পরিষদের সদস্য শাহিন মনোয়ারা হক বলেন, ‘আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলের নারীদের মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীরা সবচেয়ে অবহেলিত। এ পরিস্থিতিতে এসব নারী পাপোশ উৎপাদন করে বাড়তি উপার্জন করছেন, এটা খুবই ভালো খবর। বাড়তি উপার্জন করতে পারায় এসব নারীর আর্থিক সক্ষমতা বাড়ছে। এতে নারীর একধরনের ক্ষমতায়ন হচ্ছে।’