নাতি আল হেরাকে (৫) বড্ড ভালোবাসতেন হামিদুর রহমান (৬৫)। নাতি জিলাপি খুব পছন্দ করে। তাই যেখানেই যেতেন, তার জন্য হাতে করে জিলাপি নিয়ে আসতেন তিনি। দাদা বাড়ি থেকে বের হলেই জিলাপির জন্য অপেক্ষা করে থাকত শিশু আল হেরা। গতকাল রোববার রাত থেকে দাদাকে দেখতে না পেয়ে সে এঘর–ওঘর খুঁজে ফিরছে। অবোধ শিশুটি এখনো জানে না, দাদা আর ফিরবেন না।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নের দক্ষিণ আসাননগর গ্রামের প্রবীণ হামিদুর রহমান গতকাল রোববার অনুষ্ঠিত চতুর্থ ধাপের ইউপি নির্বাচনে গন্ডগোলের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। সারা দিন শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণের পর সন্ধ্যায় হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে, তা দেখতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন হামিদুর। সে সময়ই এ ঘটনা ঘটে।
গতকাল ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ২০টি ইউপির ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলার রাজাগাঁও ইউপির দক্ষিণ আসাননগর কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ ও গণনা শেষে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ঘোষিত ফলে ইউপি সদস্য পদে মাসুদ রানা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শাহ আলমের চেয়ে ১০২ ভোট বেশি পান। কিন্তু ওই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন শাহ আলমের সমর্থকেরা। পরে তাঁরা একত্রিত হয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লাঠিপেটা করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে ভোটকেন্দ্রের মালামাল নিয়ে যাওয়ার সময় আবারও হামলার শিকার হয় পুলিশ। আত্মরক্ষা করতে পুলিশ হামলাকারীদের লক্ষ্য করে ২০টি গুলি ছোড়েন। এতে হামিদুর রহমান নিহত হন। এ সময় আবু কালাম (৩২) নামের আরেক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। গতকালই লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সারা দিন শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণের পর সন্ধ্যায় হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে, তা দেখতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন হামিদুর। এ সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি।
রুহিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) চিত্তরঞ্জন রায় বলেন, ময়নাতদন্ত শেষ হলেই হামিদুরের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলার প্রক্রিয়া চলছে।
আজ সোমবার বেলা ১১টার দিকে হামিদুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে স্বজনদের মাতম চলছে। গ্রামবাসী হামিদুরের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এ সময় কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে হামিদুরের বাড়িতে আসেন রাজাগাঁও ইউপির নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলাম। তিনি হামিদুরের স্বজনদের নানা রকম কথা বলে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। সে সময় হামিদুরের মেয়ে হামিদা আকতার চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন আর বলতে লাগলেন, ‘এলা এসব কহে কী হবে? তোমরা হামার বাপটাক ফিরায় দিবা পরিবেন?’ বলেই আবার কাঁদতে লাগলেন।
পাশেই আরেক ঘরের বারান্দায় বসে মাতম করছিলেন হামিদুরের স্ত্রী হাসিনা বেগম (৫৮)। তিনি বলেন, ‘কত কহিনু বাড়ির বার হন না, ভোটকেন্দ্রে গন্ডগোলের কথা শুনিয়া দৌড়ে চলে গেইল। যাবার সময় কহে গেইল ওইঠে কী হচে, দেখিয়াই চলে আসিমো। আর আসিলনি।’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে তাঁর। একপর্যায়ে মূর্ছা যান হাসিনা।
প্রতিবেশী সোহরাব হোসেন (৭২) বলেন, হামিদুর সহজ-সরল স্বভাবের ছিলেন। ঝগড়াঝাঁটি পছন্দ করতেন না। সব সময় ঝামেলা এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু এই ভোটের ঝামেলাই তাঁর জীবন কেড়ে নিল।
গতকাল পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন ঘটনাস্থলে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলেন। আজ প্রথম আলোকে তিনি বলেন, হামলা করলে আত্মরক্ষায় প্রিসাইডিং অফিসারের নির্দেশে পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতেই এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, ‘আমরা সারা দিনের প্রচেষ্টায় সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিলাম। নির্বাচন শেষে এমন একটি ঘটনা সত্যি কষ্টকর।’