গতকাল শনিবার বেলা দেড়টা। ধানের ভৈরব মোকাম। বেশাখী ধানভর্তি বস্তার স্তূপ। ধানের বড় এই মজুত এখন বিক্রির অপেক্ষায়। কিন্তু ক্রেতার অভাবে এক সপ্তাহ ধরে অবিক্রীত অবস্থায় মোকাম ঘাটে পড়ে আছে প্রায় ৩০ হাজার মণ ধান। বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়া কৃষক ও পাইকারদের এই ধান শুক্রবার থেকে বৃষ্টির পানিতে ভিজছে। ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে থেমে থেমে গতকাল শনিবারও বৃষ্টি হচ্ছিল, আর ভিজছিল ধান।
বস্তাভর্তি এই ধান দুই দিন ধরে ভেজায় অঙ্কুরোদ্গম ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই অবস্থায় ধান বিক্রি করতে না পারার দুশ্চিন্তার মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে অঙ্কুরোদ্গমের শঙ্কা। এতে বিক্রি ও দাম পাওয়া নিয়ে সবার মধ্যে বাড়তি চাপ কাজ করছে।
ভৈরব উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী শরীফ খান বলেন, বস্তায় ধান যদি ভেজা অবস্থায় থাকে, তাহলে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ওই ধানে অঙ্কুরোদ্গম ঘটবে। তবে এই সময়ের মধ্যে শুকিয়ে আর্দ্রতার মাত্রা ১৪ শতাংশ নিচে নামিয়ে আনা গেলে সমস্যাটি আর হবে না।
ভৈরব বন্দর ও বাণিজ্য অঞ্চল। ব্রিটিশ আমল থেকে ভৈরব বাজার আড়তদারি ব্যবসার জন্য বিখ্যাত। বিশেষ করে ধান–চাল এই ব্যবসার প্রধান উৎস। বিশাল নদীপথকে ঘিরে মূলত এই ব্যবসার উত্থান। আর কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চলের উৎপাদিত ফসলের একাংশ ভৈরব ও আশুগঞ্জ মোকামে বিক্রি হয়।
হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার কাকালচেউ হাওর থেকে আসা পাইকার কামাল উদ্দিন ৩৩০ মণ ধান নিয়ে এসেছিলেন। বিক্রি করতে না পেরে ভৈরব মোকামে মজুত করে রেখেছেন। তিন দিন ধরে অপেক্ষায় থেকে কাঙ্ক্ষিত দর ও ক্রেতার দেখা পাননি। এ অবস্থায় দুই দিন ধরে তাঁর ধান বৃষ্টিতে ভিজছে। কামাল উদ্দিন বলেন, প্রতি সপ্তাহে দর কমছে। কালকের (রোববার) মধ্যে রোদের দেখা না পেলে ধান থেকে পুঁই (অঙ্কুরোদ্গম) বের হবে। তখন আরও কম দামে বিক্রি করতে হবে।
ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে ভৈরবে শুক্রবার সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি শুরু হয়। এই বৃষ্টি গতকাল বিকেল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এর মধ্যে কখনো কখনো ভারী বৃষ্টিপাতও হয়।
ভৈরব মোকামে গতকাল দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, অবিক্রীত ধান পাতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া বিরাজমান থাকায় পলিথিন বেশিক্ষণ ধানের বস্তায় মোড়ানো অবস্থায় রাখা যাচ্ছে না। ফলে সব বস্তা ভিজে গেছে। পাইকারেরা নানা উপায়ে বস্তাগুলো ভেজার হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছেন। মোকামে কেনাবেচা খুবই কম। হাওর থেকে ধান নিয়ে কোনো ট্রলারও ঘাটে নোঙর করেনি।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ১০ দিন আগে ভৈরব মোকামে মোটা ধান (হীরা) বিক্রি হয়েছে মণপ্রতি ৪৬০ টাকা। বর্তমানে ওই ধান মণপ্রতি ২০ টাকা কমে গেছে। গতকাল মোটা ধান বিক্রি হয়েছে ৪৪০ টাকা দরে। বিআর-২৮ জাতের ধানেও একই হারে দরপতন ঘটেছে। বিআর-২৮ এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৫২০ টাকা দরে। ১০ দিন আগে বিক্রি হয়েছে ২০ টাকা বেশি দামে। ভৈরব মোকাম থেকে মিলাররা ধান কিনছেন না। এ জন্য বিক্রি ও দাম দুই-ই কমে গেছে। গেল বছর ভারত থেকে আমদানি করা চালের পর্যাপ্ত মজুত ব্যবসায়ীদের কাছে রয়ে গেছে। এ কারণে বাজার এখনো
ভারতীয় চালের দখলে। ফলে মিলাররা ধান কিনছেন হিসাব করে। একই সঙ্গে সরকারিভাবে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ লাখ টন। মিলারদের ধারণা ছিল, এবার নানা কারণে লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়বে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সরকার থেকে ইতিবাচক ইঙ্গিত না থাকায় এবং ক্রয়কেন্দ্রে ক্রয় শুরু না হওয়ায় মিলাররা ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। মূলত এ কারণেই মোকামে অবিক্রীত ধানের মজুত বাড়ছে।
পাইকার ও কৃষকেরা আশা করছেন, আজ বিক্রি না হলেও কিংবা কাঙ্ক্ষিত দাম পাওয়া না গেলেও হয়তো কয়েক দিনের মধ্যে ক্রেতার দেখা মিলবে। বিক্রিও হবে। কিন্তু এখন বৃষ্টিতে ভেজার কারণে নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁদের।
হুমায়ুন কবির ভৈরব বাজারের একজন প্রতিষ্ঠিত ধান–চালের আড়তদার। ভৈরব বাজার খাদ্যশস্য সমিতির এই সভাপতি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি ক্রয়কেন্দ্রগুলো ধান কেনা শুরু না করা পর্যন্ত দাম কিংবা বিক্রি কোনোটাই বাড়বে না। বিক্রি না থাকায় কৃষকেরা বিপদে আছেন। এই বিপদে নতুন করে যোগ হয়েছে ঘূর্ণিঝড় ফণী।