নিয়োগবিধি সংশোধন ও গ্রেড পরিবর্তনের দাবিতে স্বাস্থ্যকর্মীদের চলমান কর্মবিরতির কারণে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে নির্ধারিত সময়ে হাম-রুবেলা টিকাদান কর্মসূচি করা যাচ্ছে না। একই কারণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা দেশে এই কর্মসূচি স্থগিত করেছে। রোববার সকাল থেকে একযোগে দেশব্যাপী কর্মসূচি শুরুর কথা ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী, পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ ডিসেম্বর। এই সময়ের মধ্যেও আন্দোলনে অংশ নেওয়া স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের অবস্থান থেকে সরে না এলে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষকে বিকল্প উপায় খুঁজে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ইস্যুটি নিয়ে আন্দোলনকারী ও সরকারের অবস্থান বিপরীতমুখী হওয়ায় পাঁচ বছর পর আসা এই কর্মসূচি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। আন্দোলনের কারণে আগে থেকে বন্ধ হয়ে আছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) কার্যক্রমও। ফলে স্বাস্থ্য বিভাগের স্পর্শকাতর ইস্যুটির কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর খুবই বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
২৬ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন কেন্দ্রীয় পর্ষদের আহ্বানে সারা দেশে একযোগে কর্মবিরতি চলছে। সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্য পরিদর্শক, সহকারী স্বাস্থ্য পরির্দশক ও স্বাস্থ্য সহকারীরা আন্দোলনে যোগ দেন। ভৈরবেও কাজে না গিয়ে আন্দোলনকারীরা প্রতিদিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরে অবস্থান করছেন এবং দাবির পক্ষে দৃঢ় রয়েছেন।
খুরশিদ আলম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে হাম–রুবেলাসহ ইপিআই কার্যক্রম সচল রাখা নিয়ে দুচিন্তার শেষ নেই তাঁর।
খুরশিদ আলম বলেন, ইপিআই কার্যক্রম স্বাস্থ্য বিভাগের অধিক স্পর্শকাতর কর্মসূচির মধ্যে একটি। আর হাম–রুবেলা কর্মসূচি আসে পাঁচ বছর বিরতি দিয়ে। মূলত মাঠপর্যায়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন এই মুহূর্তে যাঁরা আন্দোলনে রয়েছেন। হাম-রুবেলা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া নিয়ে আন্দোলনকারীদের অনাগ্রহের কারণে গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি এ বি এম খুরশিদ আলম আমাদের সঙ্গে জুম সভা করেছেন। সভা থেকে তারিখ পরিবর্তনের কথা জানানো হয়েছে। স্পষ্ট করা জানানো হয়েছে হাম-রুবেলার আর সময় পেছানোর সুযোগ নেই। তাহলে দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে। সেই কারণে অন্তত হাম–রুবেলার ব্যাপারে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানো যায় কি না, সেই চেষ্টার কথা বলেছেন। না হলে স্থানীয় বিকল্প পরিকল্পনা করার কথা বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, পোলিও, যক্ষ্মা, ডিফথেরিয়া, হুপিংকাশি, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলিস ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, হাম-রুবেল এই ১০টি রোগের ১১টি টিকা ইপিআই কার্যক্রমের অংশ। এর মধ্যে হাম-রুবেলা বিশেষ কার্যক্রমের অংশ। এই কর্মসূচি চলে বিদেশি অর্থায়নে। আর এবারই বিদেশি সহয়তায় শেষ কার্যক্রম। এরপর দেশের টাকায় এই কর্মসূচি পালন করতে হবে। সব মিলিয়ে কর্মসূচিটি নিয়ে সামনে বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এই অবস্থায় সংকট নিরসনে দৃশ্যদমান অগ্রগতি না থাকায় কর্মবিরতি প্রতিদিন দুচিন্তাকে বড় করছে।
এ ছাড়া শিশু ও গর্ভবতী নারীর জন্য সময়মতো টিকা গ্রহণ অধিক বাধ্যতামূলক। সেবার আওতায় রয়েছে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারী–পুরুষও। ভৈরব উপজেলায় এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয় দুই ভাগে। পৌর শহরে বাস্তবায়ন হয় পৌরসভার নিয়ন্ত্রণাধীন স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে। উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের কার্যক্রমের কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৬৮টি কেন্দ্রের মাধ্যমে কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয়ে আসছে। মাঠপর্যায়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয় আন্দোলনে যাওয়া স্বাস্থ্য পরিদর্শক, সহকারী স্বাস্থ্য পরির্দশক ও স্বাস্থ্য সহকারীদের মাধ্যমে। আবার তাঁদের দ্বারা কমিউিনিটি ক্লিনিকও পরিচালিত হয়।
স্বাস্থ্য পরিদর্শকদের জন্য ১১তম, সহকারী স্বাস্থ্য পরির্দশকদের ১২তম এবং স্বাস্থ্য সহকারীদের জন্য ১৩তম গ্রেড দাবি করে ২৬ নভেম্বর থেকে কর্মবিরতি শুরু হয়। আন্দোলনকারীরা একই সঙ্গে তাঁদের পদটিকে টেকনিক্যাল পদ হিসেবে স্বীকৃতিরও দাবি করছেন। আন্দোলন শুরুর পর থেকেই সরাসরি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ইপিআই কার্যক্রমে।
উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি গ্রামের গৃহবধু হাজেরা খাতুন (২৮)। চলতি সপ্তাহের মধ্যে তাঁর দেড় বছর বয়সী শিশুটির পরবর্তী ডোজের টিকা দেওয়ার কথা। কিন্তু লাগোয়া সব কটি কেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় তিনি সফল হননি।
হাজেরা বলেন, বড়রার যেমন তেমন আবুইদ্দারে (শিশু) লইয়া হেলাফেলা চলে না।
তবে পৌরসভার অধীনে থাকা কর্মরতরা এই আন্দোলনের বাইরে থাকায় শহরে ইপিআই কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। দুচিন্তা নেই হাম-রুবেলা কর্মসূচি নিয়েও।
সোমবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, কাজে যোগ না দিয়ে প্রবেশদ্বারে বসে কর্মবিরতি পালন করছেন সংশ্লিষ্টরা। কথা হয়, বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভৈরব শাখার সভাপতি হানিফ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী। হানিফ বলেন, ‘আন্দোলনে গেছি বেশ কিছুদিন হয়ে গেলেও ঊর্ধ্বতনরা আমাদের নিয়ে ভাবছে বা এই নিয়ে দুচিন্তা আছে—এমন আভাস পাওয়া যায়নি। ফলে মনে হচ্ছে আন্দোলন দীর্ঘ হবে।’
বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশনের ভৈরব শাখার সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন রশিদের ভাষ্য, বেতনবৈষম্য দূর করা এবং প্রস্তাবিত গ্রেড বাস্তবায়ন ঘোষণাটি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর। তিনি এই ঘোষণা দিয়েছিলেন ১৯৯৮ সালের ৬ ডিসেম্বর। পরবর্তী সময়ে চলতি বছরের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এ বিষয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর লিখিত অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু এখনো বিষয়টি বাস্তবায়ন হয়নি।
কষ্ট নিয়ে স্বাস্থ্য সহকারী আসমা খানম বলেন, ‘যাঁরা গরু–ছাগলের টিকা দেন, তাঁদের পদটিও টেকনিক্যাল পর্যাদায়। আর আমরা মানুষের টিকা দিয়েও টেকনিক্যাল হতে পারলাম না।’
এ ছাড়া কথা হয়, ভৈরব দাবি বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যসচিব শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সহকারী। ইপিআই কার্যক্রম বন্ধ এবং হাম–রুবেলা কর্মসূচি বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তার প্রসঙ্গটি তাঁর সামনে আনা হয়। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে ভ্যাকসিন–হিরো বলা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ টিকাদান দেশ হিসেবে আমাদের দেশ সেরা হয়েছে। স্বাস্থ্যের এই বিভাগের সাফল্যের কারণে প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত হয়েছেন। ভুলে গেলে চলবে না ভ্যাকসিন–হিরোর এই সম্মান, স্বাস্থ্য সহকারীর অবদান।’
শফিকুল ইসলাম আজ শুক্রবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, দাবি আদায় না হলে পরবর্তী তারিখেও তাঁদের পক্ষে হাম-রুবেলা টিকাদানে অংশ নেওয়া সম্ভব হবে না।