ভুট্টা চাষ বাড়ছেই, আসছে সচ্ছলতা

ভুট্টার খেতের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কয়েকজন কৃষক। সম্প্রতি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বিদ্যাধরপুর গ্রামের মাঠে। ছবি: প্রথম আলো
ভুট্টার খেতের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কয়েকজন কৃষক। সম্প্রতি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বিদ্যাধরপুর গ্রামের মাঠে।  ছবি: প্রথম আলো

মাঠের পর মাঠ ভুট্টাখেত। সোজা দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। কিছু সবুজ আর কিছু বাদামি রঙের গাছ দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। গাছে ঝুলে আছে হলুদ রঙের মোচা। অনেক গাছ থেকে মোচা কেটে নেওয়া হয়েছে। আবার অনেক গাছে কাটার কাজ চলছে। খেতগুলোতে কৃষকেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন।

কৃষকের বাড়িতেও ভুট্টা আর ভুট্টা। কেউ মাড়াই করছেন, আবার কেউ পরিষ্কার করছেন। বাড়িতে ভুট্টা আসার পর পুরুষের সহযোগিতায় মেয়েরাও কাজ করেন। এই অবস্থা এখন ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার গ্রামে গ্রামে। উপজেলায় মাঠের পর মাঠ ভুট্টা চাষ হয়েছে। ভুট্টা চাষেই দরিদ্র কৃষকেরা আর্থিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন বলে কৃষি বিভাগের ধারণা।

উপজেলা কৃষি বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, এ বছর তারা মহেশপুরে ৬ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু লাভজনক হওয়ায় এবং স্থানীয় মাটিতে ভালো ফলন হওয়ায় ওই লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উপজেলায় ৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। প্রতিবছরই ভুট্টার চাষ বাড়ছে। সূত্রটির মতে, মাত্র চার থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধানে ভুট্টা চাষ গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু তালহা বলেন, মহেশপুরে ৩৪ হাজার ৭৬০ হেক্টর চাষযোগ্য জমি আছে। সেখানে শুধু ভুট্টা চাষই হয়েছে ৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর। সে হিসাবে মোট চাষযোগ্য জমির ২২ শতাংশ জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। চাষ হওয়া এই ভুট্টার খেত থেকে ৮০ থেকে ৮৫ হাজার মেট্রিক টন ভুট্টা পাওয়ার আশা করছেন এই কর্মকর্তা। এই ভুট্টা এলাকার সাধারণ কৃষকদের আর্থিকভাবে এগিয়ে যেতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করছেন।

সরেজমিন উপজেলার আলামপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কিছু খেতে সবুজ গাছ, আর গাছে ঝুলছে ভুট্টার মোচা। কিছু খেতের গাছগুলো বাদামি হয়ে গেছে। সেগুলো থেকে মোচা কেটে নেওয়া হয়েছে। কৃষকেরা মাঠ থেকে ভুট্টা কেটে বাড়িতে নিচ্ছেন।

কথা হয় আলামপুর গ্রামের আবদুর রহমানের সঙ্গে। জানালেন, তাঁর সাত বিঘা চাষযোগ্য জমি আছে। এর মধ্যে ছয় বিঘা জমিতেই ভুট্টা চাষ করেছেন। এখন ভুট্টা কাটার কাজ করছেন। পরিবারের সবাই মিলে এই চাষে যুক্ত। তিনি আরও বলেন, এই এলাকায় এলিট, মুকুট, গৌরব, গরুর গাড়ি, ২৭২০, ৩৩৫৫, সুপার সাইনসহ নানা জাতের ভুট্টা চাষ হয়ে থাকে। কৃষকেরা সময় সময় জাত পরিবর্তন করে চাষ করেন।

একই এলাকার আরেক কৃষক সাহাবুদ্দিন আহম্মদ জানালেন ভুট্টা চাষ থেকে বিক্রির আদ্যোপান্ত। ভুট্টা চার মাসের ফসল। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে ভুট্টার বীজ বপন করতে হয়। মার্চ-এপ্রিল মাসের মধ্যেই ঘরে চলে আসে। এক বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করতে প্রায় দুই হাজার টাকার বীজ লাগে। জমি চাষ, সেচ ও সার-কীটনাশক বাবদ খরচ হয় আরও ছয় হাজার টাকা। খেতের আগাছা পরিষ্কার, জমি কোপানো, সার-ওষুধ দেওয়া, ভুট্টা কাটা, বাড়িতে নিয়ে আসা, মাড়াই ও বিক্রি উপযোগী করার শ্রমিক বাবদ খরচ হয় প্রায় তিন হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এক বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষে খরচ প্রায় ১১ হাজার টাকা। সেই জমিতে ভুট্টা পাওয়া যায় ৩০ থেকে ৩৫ জন। এ বছর ভুট্টা বিক্রি হচ্ছে গড় ৬০০ টাকা মণ দরে। সেই হিসাবে এক বিঘার ভুট্টায় পাওয়া যাচ্ছে ১৮ থেকে ২১ হাজার টাকার। অর্থাৎ বিঘায় ৭ থেকে ৯ হাজার টাকা লাভ থাকছে।

বিদ্যাধরপুর গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, অন্যান্যবার ভুট্টার মণ থাকে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এবার বাজার কিছুটা কম হওয়ায় তাঁদের লাভের পরিমাণটাও কমে যাচ্ছে। তারপরও অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষে লাভ বেশি। ফলে ধীরে ধীরে এলাকার সব কৃষকই ভুট্টা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।

এলাকার কৃষকেরা বলছেন, মোটামুটি দামে বিক্রি করতে পারলেও ভুট্টা চাষে কমবেশি লাভ থাকে। ভুট্টা বিক্রি করে এই এলাকার কৃষকেরা আর্থিকভাবে বেশ এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দাম আরও পড়ে গেলে কৃষকেরা আবার পিছিয়ে পড়বেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু তালহা বলেন, মাত্র পাঁচ বছর আগে মহেশপুরে ভুট্টার চাষ ছিল শত হেক্টরের ঘরে। তা বেড়ে এখন সাত হাজার হেক্টরের বেশি হয়ে গেছে। লাভজনক হওয়ায় ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে তিনি আশা করছেন। ভুট্টা চাষে কৃষকের আর্থিক সচ্ছলতা আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ কারণে তাঁরা ভুট্টা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করে যাচ্ছেন।