বছরের বেশির ভাগ সময় হাওরে পানি থাকায় বোরো ধান ছাড়া অন্য ধানের চাষাবাদ খুব একটা করতে পারেন না কৃষকেরা। আবার বন্যার পানিতে বোরো ফসল তলিয়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দুর্দশার সীমা থাকে না। বিষয়টি মাথায় রেখে হাওরাঞ্চলের তুলনামূলকভাবে উঁচু জমিতে আমন ধান ফলনে ‘ভাসমান বীজতলা’ পদ্ধতিতে কৃষকদের চাষাবাদে উৎসাহিত করতে কাজ করছে হবিগঞ্জের স্থানীয় একটি বেসরকারি আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক সংস্থা। এটির নাম অ্যাসোসিয়েশন ফর সোসিও ইকোনোমিক ডেভেলপমেন্ট হবিগঞ্জ (এসেড হবিগঞ্জ)।
সংস্থাটি জানিয়েছে, প্রতিবছর আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে বন্যার পানিতে হাওরের সমগ্র চাষাবাদযোগ্য জমি পানিতে নিমজ্জিত হয়। ফলে কৃষকেরা আমন ধান চাষ করার জন্য বীজতলার প্রয়োজনীয় উঁচু জমি পান না। এ সময় চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় ধান বপন করতে পারলে কয়েক মাস পর পানি নেমে গেলে কৃষকেরা আমন চাষাবাদ করতে পারতেন। এটি মাথায় রেখেই বীজতলার জন্য শুকনা জমির বিকল্প হিসেবে ভাসমান বীজতলা পদ্ধতি জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে এসেড হবিগঞ্জ। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সার্বিক পর্যবেক্ষণে এবং জাপান ফান্ড ফর গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টের আর্থিক সহায়তায় চলতি বছর থেকে এ কাজ চলছে।
প্রাথমিকভাবে সংস্থাটি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার তেঘরিয়া ইউনিয়নের আবদুল্লাহপুর ও সৈয়দাবাদ গ্রামে চলতি বছরে ভাসমান বীজতলা ব্যবহারের কাজ শুরু করেছে। এই বীজতলা তৈরির পদ্ধতি খুবই সহজ, সময়োপযোগী ও বিপদের বন্ধু। এই পদ্ধতিতে কয়েকটি কলাগাছকে বাঁশ দিয়ে পরস্পর সংযুক্ত করে ভেলা (বুড়া) বানাতে হবে। এরপর সেটির চাটাই বিছিয়ে দুই থেকে তিন ইঞ্চি স্তরের মাটি দিয়ে বীজতলা তৈরি করতে হবে। ভেলা যেন পানির স্রোতে ভেসে যেতে না পারে, সে জন্য দড়ি বা রশির সাহায্যে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে আটকে রাখতে হবে। পানির ওপর ভেসে থাকার কারণে এরূপ বীজতলায় সেচের দরকার হয় না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বীজ বপনের পর ভেলার চারপাশে জাল বা নেট দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে, যেন হাঁস, ইঁদুর কিংবা অন্যান্য পশুপাখি বপনকৃত বীজের কোনো ক্ষতি করতে না পারে। ৩ থেকে ৪ কেজি বীজের জন্য ৩৫ থেকে ৪০ বর্গমিটার বা ৭৫ থেকে ৯০ বর্গহাত ভেলা দরকার। ব্যয়ের দিক দিয়ে হিসাব করে দেখা যায়, মাটিতে সাধারণত বীজতলা তৈরিতে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। অন্যদিকে ভাসমান বীজতলা তৈরিতে খরচ হয় ১ হাজার ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকা। আবার বীজতলার চারা ওঠানোর পর ভেলায় অন্যান্য শাকসবজিও চাষ করা যায়।
এসেড হবিগঞ্জের প্রধান নির্বাহী জাফর ইকবাল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, হবিগঞ্জ সদরের আবদুল্লাহপুর ও সৈয়দাবাদ গ্রামের কৃষকেরা বোরো ধান ছাড়া অন্য কোনো ফসল ফলান না। এটি বিবেচনায় নিয়ে সেখানে বছরে তিনটি ফসল চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে উদ্যোগ নেয় এসেড বাংলাদেশ। প্রাথমিকভাবে গ্রাম দুটির ১০০ জন দরিদ্র কৃষক নির্বাচন করা হয়। তাঁদের দিয়ে বোরোর পাশাপাশি আমন ও রবিশস্য ফলানোর কার্যক্রম শুরু হয়। সে অনুযায়ী, বীজতলাতে আমন বীজ বপনও করা হয়। কিন্তু তখনই চলে আসে বন্যার পানি। এ অবস্থায় সব কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এরপরই মূলত তাৎক্ষণিকভাবে ভাসমান বীজতলা পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, গত জুলাই মাসের মাঝামাঝি চার–পাঁচজন কৃষক ভাসমান বীজতলা তৈরি করে সেখানে আমন ধান বপন করেন। পানি নেমে গেলে আগস্টের মাঝামাঝি গজিয়ে ওঠা চারাগুলো কৃষকেরা জমিতে রোপণ করবেন। বীজতলায় উৎপাদিত চারা ২০ কৃষক তাঁদের গ্রামের পাশের ঘুঙ্গিয়াজুরি হাওরে অন্তত ২০ বিঘা জমিতে রোপণ করবেন।
জাফর ইকবাল চৌধুরী বলেন, আবদুল্লাহপুর ও সৈয়দাবাদ গ্রামের কৃষকেরা বোরো ধান ছাড়া আর কোনো ফসল ফলান না। তাই বন্যা কিংবা খরায় জমির ফসল বিনষ্ট হলে তাঁদের দুর্দশার শেষ থাকে না। কিন্তু যদি তাঁরা জমিতে বছরে তিনটি ফসল ফলাতেন, তাহলে একটি মৌসুমের ফসল বিনষ্ট হলেও অপর দুটির মাধ্যমে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতেন। এ কারণেই সেখানে আমন ধান চাষাবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করতে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। যেহেতু বন্যা এসেছে, তাই বীজতলাও ডুবে যায়। পরে বন্যার পানি নেমে গেলে যেন চারার অভাব না হয়, সে জন্য ভাসমান বীজতলা পদ্ধতিতে চারা গজানোর বিষয়টিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। চারা তুলে ফেলার পর ওই ভাসমান বীজতলায় শাকসবজি চাষাবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করা হবে। এ ছাড়া ওই দুটি গ্রামের কৃষকদের রবি শস্য চাষেও উৎসাহিত করা হবে।