বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের শেষ দুই দশক তাঁর সংসারের হাল ধরেছিলেন নীহার বালা। সুলতান তাঁকে মেয়ে বলে পরিচয় দিতেন। প্রায় সাত বছর ধরে নীহার বালা (৮৪) দৃষ্টিহীন। দুই বছর ধরে তিনি শয্যাশায়ী। বিছানায় শুয়েবসে দিন কাটে তাঁর। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ-ব্যাধি। ওষুধ খেতে হয় নিয়মিত। কিন্তু টাকার অভাবে তিনি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারছেন না।
নীহার বালার স্বামী হরিপদ সাহা ছিলেন নড়াইল শহরের বাসিন্দা। প্রতিবেশী এস এম সুলতানের সঙ্গে ছিল হরিপদ সাহার ঘনিষ্ঠতা। শিল্পীকে কাকু বলে ডাকতেন হরিপদ। ১৯৭৫ সালে আকস্মিক মৃত্যু হয় তাঁর। স্বামীর মৃত্যুতে দুই মেয়ে বাসনা রানী সাহা ও পদ্ম রানী সাহাকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন নীহার বালা। তখন শিল্পী সুলতান গুরুতর অসুস্থ। তাঁকে দেখার কেউ নেই। এগিয়ে আসেন নীহার বালা। সেই থেকে নীহার বালা, তাঁর দুই সন্তান ও ছোট ভাই দুলাল সাহাকে নিয়ে শুরু হয় অকৃতদার সুলতানের সংসার। সুলতানের সব ব্যাপারে দেখাশোনা করতেন নীহার বালা।
এ বিষয়ে সুলতানের শিষ্য ও বর্তমানে নড়াইল সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের চারুকলার সহকারী শিক্ষক সমীর কুমার বৈরাগী জানান, শিল্পী সুলতানের সংসার ও শিশুস্বর্গ পরিচালনায় অভিভাবক ছিলেন নীহার বালা। তাঁকে ঘিরেই চলত সুলতানের সংসার। সুলতান নীহার বালাকে মেয়ে বলে পরিচয় দিতেন, স্নেহ করতেন নিজের মেয়ের মতোই। নীহার বালা শিল্পীকে ডাকতেন কাকু বলে।
সুলতানের মৃত্যুর পর ২০০৪ সালে নড়াইলের মাছিমদিয়ায় শিল্পীর বাড়িতে সরকারি উদ্যোগে তৈরি হয় স্মৃতি সংগ্রহশালা। তখন ওই সংগ্রহশালার দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে সরকারিভাবে দুই কামরার আধা পাকা একটি টিনের ঘর করে দেওয়া হয় নীহার বালাকে। নীহার বালার মেয়ে বাসনা মারা গেছেন ২০০৩ সালে, আরেক মেয়ে পদ্ম মারা গেছেন ২০১৭ সালে। বর্তমানে পদ্ম রানীর ছেলে নয়ন বৈদ্য, তাঁর স্ত্রী ও ছোট সন্তানকে নিয়ে নীহার বালার সংসার।
নয়ন বৈদ্য সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার অফিস সহায়ক। বেতন পান চার হাজার টাকা। নীহার বালাকে সরকারি ভাতা দেওয়া হয় পাঁচ হাজার টাকা। এই ৯ হাজার টাকায় চলে তাঁদের সংসার।Ñএসব কথা জানান নয়ন বৈদ্য। নয়ন বৈদ্য বলছিলেন, ‘দিদার অ্যাজমা ও বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা রয়েছে। প্রতি মাসে ওষুধ কিনতে ছয় হাজার টাকার বেশি লাগে। অনেক সময় প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনাও সম্ভব হয় না টাকার অভাবে। দিদা যত দিন বেঁচে থাকবেন, সেই সময়টুকুর জন্য তাঁর ভাতা ও চিকিৎসা বাবদ আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানো হলে তাঁর শেষ জীবনটা ভালো ভাবে কাটত।’
গত শুক্রবার নীহার বালার ঘরে বসে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। শিশুস্বর্গ পূর্ণাঙ্গ রূপ পাক এবং এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার আরও উন্নয়ন হোক—শুধু এই চাওয়াটুকু মৃত্যুপথযাত্রী নীহার বালার। ব্যক্তিগত আর কোনো চাওয়া নেই তাঁর।
নড়াইলের জেলা প্রশাসক ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির সভাপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা ও শিশুস্বর্গকে আরও আধুনিক করতে পরিকল্পনা করছি। নীহার বালার ব্যাপারেও ঊর্ধ্বতন মহলে কথা হয়েছে।’
বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইল শহরের মাছিমদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। আজ রোববার শিল্পীর ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী।