চাষাবাদ, যাতায়াত ও মাছ আহরণে সমস্যা। বিপাকে ২০ হাজার জেলে। সেচসংকটে ২০ হাজার একর জমির বোরো চাষ।
পঞ্জিকায় বর্ষা শেষ হলেও বৃষ্টিপাত থেমে নেই। এই সময়ে দেশের নদ-নদী ও জলাশয় পানিতে টইটম্বুর থাকে। তবে দেশের সবচেয়ে বড় হ্রদ রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের অবস্থা ভিন্ন। ভরা মৌসুমেও এই হ্রদে পানির স্তর স্বাভাবিকের তুলনায় এখনো কম। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতসহ তিন কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
হ্রদের এই অবস্থার কারণে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। মানুষের জীবিকা, যোগাযোগ, পণ্য পরিবহনসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। বিপাকে পড়েছেন হ্রদের ওপর নির্ভরশীল চাষি ও জেলেরা। কাপ্তাই হ্রদকে কেন্দ্র অন্তত ২০ হাজার একর জমিতে বোরো চাষ হয়। হ্রদে পর্যাপ্ত পানি থাকায় সেচসংকটে এসব জমি চাষ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কাপ্তাই হ্রদের পানিস্বল্পতার প্রভাবে কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে লবণাক্ততা বাড়তে পারে।
১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ হয়। এরপর কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টি হয়। রাঙামাটি সদরসহ আট উপজেলায় কাপ্তাই হ্রদের পানি বিস্তৃত। কাপ্তাই হ্রদে এখন ১০৮ ফুট পর্যন্ত পানি রাখা সম্ভব হয়।
রাঙামাটি আবহাওয়া কার্যালয় জানায়, চলতি বর্ষায় জুলাই মাসে রাঙামাটি জেলায় ৪৭৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। চলতি মাসের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত রাঙামাটিতে ৩৬০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে হ্রদের সঙ্গে যুক্ত চারটি নদী ও আশপাশের বাইরে অধিকাংশ বৃষ্টি হয়। তা ছাড়া হালকা বৃষ্টি হয়েছে অধিকাংশ সময়।
ভরা মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদে এত কম পানি আগে কখনো দেখেননি বলে জানান পার্বত্য নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন পানির অভাবে চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। পানি বৃদ্ধি না পেলে কয়েক লাখ মানুষ সংকটে পড়বে।
কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে বর্তমানে চারটি চালু আছে। হ্রদে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রের সর্বোচ্চ উৎপাদনক্ষমতা ২৪০ মেগাওয়াট। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ভরা মৌসুম।
কাপ্তাই হ্রদের পানি কমার প্রভাব চট্টগ্রাম নগরেও পড়বে। কেননা, কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে পানি ছাড়া না হলে কর্ণফুলী ও হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাবে।মো. মনজুরুল কিবরীয়া, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেক কম বলে জানান কাপ্তাই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এ টি এম আবদুজ্জাহের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অন্যান্য বছর এই সময়ে হ্রদে পানি বেড়ে যাওয়ায় তা ছেড়ে দিতে হতো। কিন্তু এবার অবস্থা একেবারে ভিন্ন। সামনের দিনে পানি না বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন আরও কমবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি জীবিকা ও যাতায়াতে কাপ্তাই হ্রদের গুরুত্ব অনেক। রাঙামাটির জেলার পাঁচ উপজেলার অন্তত তিন লাখ মানুষ কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল। কাপ্তাই হ্রদে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় অনেকের আয়ের উৎস সীমিত হয়ে পড়েছে।
মাছের প্রজননের কারণে গত মে থেকে জুলাই পর্যন্ত হ্রদে মাছ আহরণ বন্ধ রেখেছে প্রশাসন। এর মধ্যে পানি কম থাকায় এই সময়সীমা ২০ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এতে ২০ হাজার জেলে জীবিকাসংকটে আছেন।
যোগাযোগ করা হলে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বৃষ্টি কম হওয়ায় হ্রদে এখনো মা মাছ ডিম ছাড়ছে। এ জন্য মাছ আহরণ বন্ধের সময় বাড়ানো হয়েছে। কিছুদিন পর্যবেক্ষণের পর মাছ ধরার অনুমতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরীয়া প্রথম আলোকে বলেন, কাপ্তাই হ্রদের পানি কমার প্রভাব চট্টগ্রাম নগরেও পড়বে। কেননা, কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে পানি ছাড়া না হলে কর্ণফুলী ও হালদা নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাবে। এতে নগরে ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে লবণাক্ততা থাকতে পারে।