ফরিদপুরে উন্নয়নের স্বপ্ন

ব্যবসায় স্বর্ণযুগ শুরুর আশা

স্বপ্নের সেতুর ওপর দিয়ে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষা ফুরাচ্ছে ২৫ জুন। সেতুর উদ্বোধন নিয়ে শুরু হয়েছে উচ্ছ্বাস–উদ্দীপনা। যোগাযোগব্যবস্থার মাইলফলক এই সেতুকে কেন্দ্র করে শিল্পোন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের আশায় বুক বাঁধছেন দক্ষিণের মানুষ, দেখছেন নতুন নতুন স্বপ্ন।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গের ২১টি জেলায় স্বর্ণযুগের সূচনা করবে। অবহেলিত এ জেলাগুলোর উন্নতি হবে। লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং সর্বোপরি জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। এমনই মনে করছেন ফরিদপুরের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক, উদ্যোক্তা, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও দি মীর গ্রুপের চেয়ারম্যান মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতু আমাদের একটি স্বপ্নের প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে নিজেদের টাকায় নির্মিত একটি স্থাপনা। বিশ্বব্যাংক যখন মুখ ফিরিয়ে নিল, সেই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ এ উদ্যোগ বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে। এ কারণে এ সেতু আমাদের মর্যাদার প্রতীক।’

পদ্মা সেতু চালুর পর ফরিদপুর সদর উপজেলার বাখুণ্ডায় অবস্থিত জুবাইদা করিম জুট মিলের মতো আরও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার আশা করছেন ব্যবসায়ীরা

মীর নাসির হোসেন আরও বলেন, দক্ষিণবঙ্গ ছিল অবহেলিত। এ অঞ্চলের কোনো কোনো জেলার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অনেক খারাপ। মানুষের জীবনযাত্রার মান ছিল নিম্নগামী। সে ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু জাদুর কাঠি হিসেবে কাজ করবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে এ সেতু। পদ্মায় সেতু উদ্বোধনের পরদিন থেকেই যানবাহন চলাচল শুরু হবে, রেলপথের নির্মাণকাজ চলছে। পাশাপাশি জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের নির্মাণকাজ চলছে, যা পায়রা সমুদ্রবন্দর ও ভোলার সঙ্গে যুক্ত হবে। এ অবস্থায় পদ্মা সেতু দিয়ে যদি গ্যাস নেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে অভূতপূর্ব উন্নয়নের স্বর্ণদ্বার খুলে যাবে। কলকারখানা স্থাপিত হবে, লাখো মানুষের কর্মসংস্থান ঘটবে। পদ্মা সেতু জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও একেএইচ গ্রুপের পরিচালক শামীম হক বলেন, পদ্মা সেতু ফরিদপুরসহ দক্ষিণবঙ্গের বিশাল পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। এ সেতু ব্যবসায়ীদের জন্য উন্নয়নের দ্বার খুলে দেবে। ঢাকা থেকে গাজীপুর, কাঁচপুর বা সাভারে যাওয়া-আসা করতে যে সময় লাগে, তার অর্ধেক সময় লাগবে ফরিদপুরসহ এ অঞ্চলে আসতে। পাশাপাশি ওই অঞ্চল থেকে এ অঞ্চলে জমির দাম কম। শ্রমিকের সহজলভ্যতা রয়েছে। যার ফলে এ অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হবেন শিল্পপতিরা। একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে যেসব অনুকূল পরিবেশ থাকা দরকার, তার সবকিছুই এ অঞ্চলে রয়েছে। শামীম হক আরও বলেন, ব্যাপকভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হলে এ অঞ্চলের বেকারত্ব হ্রাস পাবে।

বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বিএম জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হক বলেন, বাংলাদেশ সোনালি আঁশের দেশ। সোনালি আঁশের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। ফরিদপুর বরাবরই পাটের জন্য বিখ্যাত। ফরিদপুরে অনেকগুলো পাটকল রয়েছে। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানই মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে। সংকট থেকে উত্তরণে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। সরকারি পাটকলগুলো সুচারুভাবে পরিচালনার পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে ফরিদপুরসহ পাট–অধ্যুষিত জেলাগুলোতে আরও পাটকল স্থাপন করা প্রয়োজন। পদ্মা সেতুর কারণে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। তবে সরকারি উদ্যোগে একটি অর্থনৈতিক শিল্প জোন গড়ে তোলা জরুরি। তাহলে শিল্পের পাশাপাশি কৃষির উন্নতি ঘটবে ও বেকারত্ব হ্রাস পাবে।

জহিরুল হক আরও বলেন, কোনো দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে শিল্পের উন্নয়নের মানদণ্ডে। এ অঞ্চলের উন্নয়নের গতি জোরদার করতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া পয়েন্টে পদ্মা নদীর ওপর আরেকটি সেতু কিংবা টানেল নির্মাণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ফরিদপুরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা জরুরি, যাতে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ও মেধার উন্নয়ন ঘটে। পাশাপাশি যেসব স্কুল–কলেজ, টেকনিক্যাল কলেজ রয়েছে, সেগুলোর মানোন্নয়ন করা প্রয়োজন।

ফরিদপুরে অন্যতম শিল্পপ্রতিষ্ঠান করিম গ্রুপের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে খুলে যাবে বাংলাদেশের ‘দক্ষিণা দুয়ার’। এখন এ অঞ্চলের উন্নয়নে আরও কিছু কাজ করা প্রয়োজন। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে সড়কগুলো প্রস্তুত করা। প্রধান সড়কগুলো ন্যূনতম চার লেনবিশিষ্ট হওয়া জরুরি। পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা আর সাশ্রয়ী মূল্যে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া জরুরি। জাহাঙ্গীর মিয়া আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ফরিদপুরের সন্তান। ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করা গেলে ফরিদপুরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু অক্ষয় হয়ে থাকবেন।

ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি আওলাদ হোসেন বলেন, ফরিদপুরে এখন প্রয়োজন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা। সেখানে অন্তত দুই লাখ পরিবারের কর্মসংস্থান সম্ভব হবে। রপ্তানি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সহায়ক শক্তি হবে পদ্মা সেতু। আগে বিদেশে কোনো পণ্য রপ্তানি করতে হলে ফেরিঘাটে ৮ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত বসে থাকতে হয়েছে। এর ফলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী সময় রক্ষা করা যায়নি। এখন ওই পণ্য ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রামে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। দেশীয় উদ্যোক্তার পাশাপাশি বিদেশিরাও বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন।

পদ্মা সেতু দক্ষিণবঙ্গের উন্নয়নে সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে মন্তব্য করে আওলাদ হোসেন আরও বলেন, ফরিদপুরে আগে যেখানে ২০টির মতো শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল, সেখানে নতুন করে আরও অন্তত ৪০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। এর ফলে ৪০ হাজার ব্যক্তির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এর ফলে ৪০ হাজার পরিবার উপকৃত হবে। সরকার রপ্তানি ও আমদানি করে দুভাবেই লাভবান হবে। জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে। পদ্মা সেতু দক্ষিণের ২১টি জেলার জন্য স্বর্ণযুগের সূচনা করবে।