যশোরের কেশবপুর উপজেলার বিল খুকশিয়ায় ৪৮ বিঘা জমি আছে কৃষক আবদুল মান্নানের। গত মৌসুমে ওই জমি জলাবদ্ধ ছিল। তবে সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সরিয়ে সেখানে ১২ বিঘা জমিতে তিনি বোরো চাষ করেছিলেন। ধান পেয়েছিলেন ১৮৫ মণ। কিন্তু ভবদহ অঞ্চলের বিলের এই জমিতে এবার বোরো আবাদের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তিনি। কারণ, তাঁর সব জমি এখনো পানির অনেক নিচে।
কৃষক আবদুল মান্নানের বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বরুণা গ্রামে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার বিলে অনেক পানি। বিলের নিচু অংশে এখনো থই পাওয়া যাচ্ছে না। বিল সেচে বোরো ধান করার মতো অবস্থা নেই। কোনো বীজতলা তৈরি করতে পারিনি। এবার আর বোরোর আবাদ হবে না।’
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার পোড়াডাঙ্গা গ্রামের কৃষক অজিত মল্লিকের বিল বোকড়ে জমি আছে ১২ বিঘা। গত বছর তিনি সেচযন্ত্র দিয়ে সেচে ওই জমিতে বোরোর চাষ করেছিলেন। ধান পেয়েছিলেন প্রায় ৪০০ মণ। তিনি বলেন, ‘এবার বিলে এখনো পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ফুট জল। বিল সেচার উপায় নেই। ধান হবে না। কী খেয়ে যে বাঁচতি হবেনে!’
যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। পলি পড়ে এই অঞ্চলের মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদ–নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এ কারণে এই এলাকার পানি নামছে না। প্রতিবছর বৃষ্টিতে এলাকার বিলগুলো প্লাবিত হয়। বিল উপচে পানি ঢোকে বিলসংলগ্ন গ্রামগুলোয়। পানিতে তলিয়ে যায় প্রায় ৪৮৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা। পানিবন্দী হয়ে পড়ে অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ।
কৃষকেরা বলেন, এ বছর বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। কিন্তু নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় এলাকার বিলগুলো জলাবদ্ধ হয়ে রয়েছে।
যশোর আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, যশোরে প্রতিবছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে। তবে গত বছর জেলায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। সূত্রমতে, ২০১৭ সালে জেলায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল ২ হাজার ১১৫ মিলিমিটার, ২০১৮ সালে ১ হাজার ১৯৫ মিলিমিটার এবং ২০১৯ সালে ১ হাজার ৫৬২ মিলিমিটার।
ভবদহ অঞ্চলে অন্তত ৫২টি বিল আছে। গত শনিবার ও গতকাল রোববার ভবদহ অঞ্চলের অন্তত ১০টি বিল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বিল–সংলগ্ন মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদ–নদী শুকিয়ে সরু খালের মতো হয়ে গেছে। ভবদহ জলকপাটের (২১ ভেন্ট স্লুইসগেট) সামনে শ্রী নদী পলি জমে উঁচু হয়ে গেছে। নদীর এই অংশ শুকিয়ে গেছে। ২৪টি কপাটের (ভেন্ট) সব কটি পলিতে তলিয়ে আছে। ৯টি কপাট থেকে ত্রিমোহিনী পর্যন্ত প্রায় ৭০০ মিটার শ্রী নদী পলি জমে উঁচু হয়ে আছে। নদীর এই অংশ একেবারেই শুকিয়ে আছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নামছে না। বিলে পানি আটকে আছে।
অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুর উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলা তিনটির ভবদহ অঞ্চলে কৃষক আছেন প্রায় ৫০ হাজার। ওই অঞ্চলে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়।
অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বিকাশ রায় বলেন, সুন্দলী ইউনিয়নে ১৪টি ছোট–বড় বিল আছে। এর মধ্যে সেচে একটি বিলের মাত্র অর্ধেক অংশে বোরোর চাষ হচ্ছে। অবশিষ্ট বিলে এত জল যে সেচে বোরো চাষ করার মতো অবস্থা নেই। বোরোর আবাদ না হলে এলাকায় এবার খাদ্যের সংকট তীব্র হবে।
মনিরামপুর উপজেলার হরিদাশকাটি ইউপির চেয়ারম্যান বিপদ ভঞ্জন পাঁড়ে বলেন, ভবদহ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিল হচ্ছে বিল বোকড়। বিলটিতে এখনো অনেক জল। বিল সেচে বোরো ধান চাষের কোনো সুযোগ নেই। বিল ডুমুরে জল কিছুটা কম আছে। কিন্তু তা সেচে বোরো ধান করার মতো অবস্থায় নেই।
মনিরামপুরের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হীরক কুমার সরকার বলেন, ভবদহ এলাকার ছোট বিলগুলো সেচে বোরো চাষের জন্য কৃষকেরা উদ্যোগী হন। এবার শীতকাল দীর্ঘ হয়েছে। এ কারণে কৃষক বীজতলা তৈরি করতে দেরি করেছেন। বোরো চাষও দেরিতে শুরু হয়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি বোরো ধান রোপণের শেষ সময়। এরপর বলা যাবে কী পরিমাণ জমিতে বোরোর চাষ হচ্ছে না। তবে এই মুহূর্তে বিলের যে অবস্থা, তাতে উপজেলার ভবদহ অংশে প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হবে না।
নদী খননের জন্য বাঁধ দেওয়ায় বিল থেকে ঠিকমতো জল নামছে না বলে জানিয়েছেন কেশবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মহাদেব চন্দ্র সানা। তিনি বলেন, এলাকার কৃষকেরা ছোট বিলগুলো সেচে বোরো চাষের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তারপরও উপজেলায় প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হবে না।
অভয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম ছামদানী বলেন, ‘বিলের এত খারাপ অবস্থা আমি আগে কখনো দেখিনি। এবার উপজেলার ভবদহ অংশে প্রায় এক হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করা সম্ভব হবে না।’
বেশির ভাগ বিলে এবার বোরো ধানের চাষ হবে না বলে আশঙ্কা করছেন ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ। তিনি বলেন, ভবদহে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের নামে চার বছর ধরে কেবল নদী খনন করা হচ্ছে। এতে নদীর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। কৃষকেরা সেচ দিয়ে কিছু বিলে বোরো ধান চাষের চেষ্টা করছেন। সমস্যা সমাধানে টিআরএমের (টাইডল রিভার ম্যানেজমেন্ট—জোয়ারাধার) কোনোই বিকল্প নেই।
পাউবোর যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম বলেন, বিল থেকে পানি নামানোর জন্য মনিরামপুরের শ্রী নদীর সঙ্গে কপালিয়া খালের মুখের পলি এক্সকাভেটর দিয়ে অপসারণ করা হয়েছে। অভয়নগরের আমডাঙ্গা খালের পলিও অপসারণ করে দেওয়া হয়েছে। কেশবপুরের বিল খুকশিয়ায় হরি নদীর সঙ্গে একটি চ্যানেল তৈরির কাজ চলছে। এতে বিলের কিছুটা পানি নেমে যাবে।