বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের দিন পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের এই প্রথম দিনে সব বয়সের মানুষ মেতে ওঠে উৎসবে। শুভেচ্ছা বিনিময়, শোভাযাত্রাসহ নেচে-গেয়ে দিনটি উদ্যাপন করা হয়। এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলায় বিক্রি হয় মাটির তৈরি আকর্ষণীয় খেলনা ও গৃহস্থালিসামগ্রী। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে মাটির তৈরি এসব সামগ্রী বিভিন্ন স্থানে বিক্রির জন্য দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে মাদারীপুরের সাতটি গ্রামের পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়ন, কালকিনি উপজেলার থানার মোড় এলাকা, ডাসার থানার ঘোষেরহাট বাজার এলাকা, শিবচর উপজেলার ভদ্রাসন ইউনিয়নের ও নলগোড়া এলাকা, রাজৈর উপজেলার বদরপাশা ও খালিয়া পালপাড়া গ্রামের শতাধিক পরিবার এই মৃৎশিল্পকে ধরে রেখেছে।
গত বুধবার এসব গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মৃৎশিল্পীরা মাটির গাছ, পাখি, ফুল, ফুলের টব, ফলমূলসহ বিভিন্ন বাসনকোসন তৈরি করছেন। কেউ মাটি গুঁড়া করে কাদা করছেন, কেউ মাটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি-পাতিল তৈরিতে ব্যস্ত। আবার কেউ মাটির তৈরি জিনিসপত্রে রংতুলি দিয়ে হরেক রকমের নকশা করছেন। অনেকে পণ্যগুলো রোদে শুকাচ্ছেন। এই কাজে মৃৎশিল্পীদের ছেলেমেয়েরাও অংশ নিয়েছে।
এই মৃৎশিল্পের প্রধান উপকরণ মাটি। তাই মৃৎশিল্পীরা বিভিন্ন নদী থেকে মাটি সংগ্রহ করেন। চাকার মাধ্যমে মাটিকে বিভিন্ন আকৃতি দেওয়া হয় এখানে। তারপর সেই মাটির সামগ্রীগুলো আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করা হয়। মৃৎশিল্পীরা জানান, বাসনকোসনের চেয়ে খেলনাসামগ্রীর চাহিদা অনেক বেশি। মেলা, ঈদ, পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে এসব পণ্য বেশি বিক্রি হয়।
সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়নের পালপাড়ায় প্রায় ৪০টি পরিবার বসবাস করে। তাদের অনেকেই এই পেশা ছেড়ে দিয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১০টি পরিবার মৃৎশিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছে।
এই গ্রামের প্রবীণ মৃৎশিল্পী বিশ্বজিৎ পাল বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের কাজ করি। এখন তেমন একটা করি না। জীবিকার জন্য কৃষিকাজ করি। বৈশাখ এলে মেলায় কিছু মাটির জিনিস বিক্রি হয়। তাই মাটির খেলনা বানাচ্ছি।’
মিনারা রানী নামের আরেক মৃৎশিল্পী বলেন, ‘আগে মাটি কিনে আনতে হতো না। এখন মাটি কিনে আনতে হয়। মাটিরও অনেক দাম। সারা দিন বাড়ির সব কাজ করার পাশাপাশি কিছু মাটির পাত্র বানাই। তাতে আমার ছেলে ও মেয়ের পড়াশোনার খরচ হয়। আমার দুই মেয়ে ও এক ছেলের সবাই পড়াশোনা করে।’
কালকিনি উপজেলার থানার মোড় এলাকার পালপাড়া গ্রামের মৃৎশিল্পী রানী পাল বলেন, প্রতিবারের মতো এবারও বৈশাখী মেলার জন্য হরিণ, গরু, ঘোড়া, হাতি, খরগোশ, উটপাখি, হাঁস, বক, টিয়া, গন্ডারসহ নানা ধরনের খেলনা তৈরি করেছি। এখন এসব শুকাতে দিয়েছি। দু-এক দিনের মধ্যে সব তৈরি হয়ে যাবে।’
পালপাড়া গ্রামের প্রবীণ মৃৎশিল্পী সুশীল কুমার পাল বলেন, ‘৫০ বছর ধরে মাটির তৈরি এসব জিনিস তৈরি করছি। বৈশাখ এলে আমাদের কাজের চাপ বেড়ে যায়। এ ছাড়া বছরের আর বাকি দিনগুলো আমাদের অনেক কষ্টে পার করতে হয়। তাই অনেকে এই পেশা এখন ছেড়ে দিয়েছে।’
জানতে চাইলে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জেলায় পাল সম্প্রদায়ের বেশ কিছু পরিবার মাটির সামগ্রী তৈরি করে। মৃৎশিল্প আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। সরকার এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তাঁদের কাজ করতে অর্থের প্রয়োজন হলে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। তাঁদের সামাজিক কোনো সমস্যা হলে তাঁরা তা আমাদের কাছে জানাতে পারেন। আমরা তাঁদের সেই দিক থেকেও সহযোগিতা করব।’