নরসিংদীর বেলাবতে সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে লোকালয় ও কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে একের পর এক ইটভাটা। এসব ভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষিজমি ও নদীতীরের মাটি। একদিকে আবাদি জমির পরিমাণ যেমন কমছে, অন্যদিকে ভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ার প্রভাবে ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে।
স্থানীয়রা বলছেন, বেলাব উপজেলার প্রায় সব কটি ইটভাটা লোকালয়ের পাশে নতুবা নদীতীরবর্তী আবাদি জমিতে। ভাটাগুলোর কারণে শুধু কৃষির ওপর নির্ভরশীল উপজেলাটির পরিবেশ এখন বিপর্যয়ের মুখে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে ফসল উৎপাদনে। খননযন্ত্র দিয়ে বিভিন্ন এলাকার কৃষিজমি থেকে মাটি কাটা হচ্ছে ভাটার জন্য। এসব ভাটার অধিকাংশই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার দায়িত্ব থাকলেও তারা দেখেও দেখে না।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, লোকালয় থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরত্বে ইটভাটা স্থাপনের আইন থাকলেও বেলাব উপজেলার গাংকুলপাড়ায় লোকালয়ের ১০০ মিটারের মধ্যেই ফসলি জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ফেভারিট ব্রিকস লিমিটেড নামের একটি ইটভাটা। আশপাশের ফসলি জমি ও নদীতীরের মাটি কেটে পাশেই স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ইটভাটাটির কিছু শ্রমিক ইট তৈরি করছেন। ভাটার সীমানা ঘেঁষে বিস্তৃত ফসলের মাঠ। তবে সেসব জমিতে কোনো চাষাবাদ হচ্ছে না। স্থানীয়রা বলছেন, ইটভাটার কারণে এসব জমিতে ফসল ভালো হয় না। তাই কৃষকেরাও এসব জমিতে চাষবাদ করছেন না। ভাটাটির মালিক আমানুল্লাহ আমান স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। ভাটাটির ৩০০ মিটার দূরত্বে নদীতীরবর্তী একটি জমি থেকে খননযন্ত্র (ভেকু) দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। মাহিন্দ্র ট্রাক্টর (স্থানীয় নাম ইছার মাথা) দিয়ে এসব মাটি বহন করা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, এসব মাটি যাচ্ছে ওই ইটভাটায়।
কিন্তু আমানুল্লাহ বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, বৃষ্টির কারণে দুই মাস ধরে কোনো ইটভাটাতেই মাটি নেওয়া হচ্ছে না। আর ফসলি জমির মাটি দানা দানা হওয়ায় এসব মাটি দিয়ে ইট বানানো যায় না। বিভিন্ন মাধ্যমে নদী বা বিলের তীরবর্তী মাটি সংগ্রহ করে ইট বানানো হয়।
ভাটাটির ১৫০ মিটার দূরে বসবাসকারী এক নারী বলেন, ‘ভাটার কয়লার সঙ্গে প্রচুর জোঁক চলে আসছে। জোঁকের উপদ্রবে গরু-ছাগল মাঠে চরাতে পারি না।’
বেলাব উপজেলার আরও পাঁচটি ইটভাটা ঘুরে আশপাশের অন্তত ৫০ জনের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তাঁরা জানান, লোকালয় ঘেঁষে আবাদি জমিতে এভাবে ইটভাটা নির্মাণের বিরুদ্ধে স্থানীয় কৃষকেরা। কিন্তু ভাটার মালিকেরা প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পান না। ফসলি মাঠের কাছাকাছি ভাটা তৈরি হলে আশপাশের জমিগুলোতে ফসলের আবাদ হয় না। এ ছাড়া জমির মাঝখান থেকে গভীর করে মাটি কাটার ফলে পাশের জমিগুলোও ভেঙে যাচ্ছে। ফলে কৃষকদের বাধ্য হয়ে ভাটার মালিকদের কাছে মাটি বিক্রি করতে হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন বলছে, সরকারি হিসাবে বেলাব উপজেলায় ১৫টি ইটভাটার নিবন্ধন রয়েছে। নিবন্ধন নেওয়া হয়নি এমন আরও কয়েকটি ভাটা থাকতে পারে। তবে অধিকাংশ ভাটাই কোনো না কোনোভাবে অবৈধ। কারণ জনবহুল এই দেশের বাস্তবতায় সব নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে ইটভাটা পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক সাফায়েত আহাম্মদ সিদ্দিকী বলেন, ‘ফসলি জমির উর্বর মাটির অংশটুকু ইটভাটায় প্রধান কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর কৃষিজমি ১ শতাংশ হারে অকৃষিজমিতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে কৃষিজমি কমতে থাকলে ভবিষ্যতে আমাদের কৃষি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। বিভিন্ন সময় কৃষকদের অভিযোগ পেয়ে জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় অনেকবার এই শঙ্কার কথা বলেছি। কিন্তু মালিকেরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় নানা পন্থায় ইটভাটার অনুমোদন নিয়ে ফেলেন।’
আসাদুজ্জামান নামের স্থানীয় একজন কৃষক বলেন, ‘ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় গাছপালা মরে যাচ্ছে, ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। একসময় প্রচুর কাঁঠাল, লিচুসহ বিভিন্ন ফল এখানে প্রচুর পরিমাণে হতো। এখন আর সেসব গাছে তেমন ফলন হয় না।’
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাফিজুর রহমান জানান, যেসব ইটভাটা নিয়ম না মেনে পরিচালিত হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সমসের জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘ইটভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়া ও ছাইয়ের কারণেই ফসলের অনেক ক্ষতি হয়। এত ইটভাটা থাকার কারণে এলাকার ফসলি জমি ও রাস্তাঘাটেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। শুধু কৃষির ওপর নির্ভরশীল এই বেলাবতে এত ইটভাটা থাকার দরকার ছিল না।’
ইউএনও শামীমা শারমীন গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটার বিষয়ে স্থানীয়দের অভিযোগ পেলে এবং আমাদের নজরে এলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’