বিষ পানে মারা যাওয়া দুই কৃষকের পরিবারসহ নিজেদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর নিমঘটু গ্রামের সাঁওতাল কিষান-কিষানিরা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) সদর দপ্তর ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছেন।
সোমবার দুপুর ১২টার দিকে শিশুসহ কয়েক শ নারী-পুরুষ ‘বরেন্দ্র ভবন’–এর ভেতরে গিয়ে বসে পড়েন।
এর আগে সকালে তাঁরা রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব ভলান্টারি অর্গানাইজেশন (সিসিবিভিও) এতে সহযোগিতা করে।
এ ছাড়া জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবর একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। এতে সেচ কার্যক্রমের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএমডিএ কর্তৃপক্ষকে তদন্তের আওতায় এনে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ, নলকূপ পরিচালনার ক্ষেত্রে কৃষকবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে নলকূপ অপারেটর হিসেবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও প্রান্তিক কৃষকদের অগ্রাধিকার এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ও প্রন্তিক কৃষকদের পর্যাপ্ত পরিমাণে সেচের পানি নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়। স্মারকলিপিতে পানি ব্যবস্থাপনায় নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরা হয়।
স্মারকলিপিতে আত্মহত্যা করা কৃষক অভিনাথ মারানডির স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম, রবি মারানডির ভাই সুশীল মারানডি; সিসিবিভিওর গ্রাম সংগঠন রক্ষাগোলা সমন্বয় কমিটির সভাপতি সরল এক্কা, উপদেষ্টা প্রসেন এক্কা, সদস্য রঞ্জিত পাহাড়িয়া ও সিসিবিভিও প্রতিনিধি মো. আরিফ সই করেন। স্মারকলিপি দেওয়ার পর তাঁরা বরেন্দ্র ভবন অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করেন। তাঁদের আসার খবর পেয়ে আগেই বরেন্দ্র ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছিল পুলিশের একটি দল।
খরতাপের মধ্যে প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে শিশুসন্তানদের সঙ্গে নিয়ে কয়েক শ নারী–পুরুষ দুপুর ১২টায় বরেন্দ্র ভবনের সামনে আসেন। এ সময় প্রধান ফটকে তাঁদের বাধা দেয় পুলিশ। তখন পুলিশকে আশ্বস্ত করা হয়, শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান কর্মসূচি পালন হবে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ তাঁদের ভেতরে ঢুকতে দেয়। এরপর সাঁওতাল কিষান-কৃষানিরা বরেন্দ্র ভবনের সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে পড়েন।
এ সময় রোজিনা হেমব্রম, সুশীল মারানডিসহ একটি প্রতিনিধিদল বিএমডিএর ভারপ্রাপ্ত সচিব ইকবাল হোসেনের কক্ষে গিয়ে স্মারকলিপি দেন। তাঁদের সঙ্গে উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি কৃষ্ণ কুমার সরকার এবং সিসিবিভিও প্রতিনিধি মো. আরিফসহ রক্ষাগোলা কমিটির কয়েকজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সচিবকে বলেন, দুই কৃষকের আত্মহত্যার দায় বিএমডিএকে নিতে হবে এবং পানিবণ্টন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।
ঘটনার পর অনেকেই দুই কৃষকের বাড়ি গিয়ে পরিবারকে সান্ত্বনা দিলেও বিএমডিএর চেয়ারম্যান বেগম আখতার জাহান এখনো কেন যাননি, সেই প্রশ্ন তোলা হয় সচিবের কাছে। তাঁরা বলেন, ‘বিএমডিএ কৃষককে নিয়ে ব্যবসা করছে। অথচ কৃষক মরলে এর চেয়ারম্যান কেন যাননি?’ সচিব এ সময় চুপ থাকেন। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, স্মারকলিপিতে থাকা অভিযোগগুলো দেখে তাঁরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।
উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি কৃষ্ণ কুমার সরকার এবং সিসিবিভিও প্রতিনিধি মো. আরিফ বলেন, দুই কৃষকের মৃত্যুকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। বিএমডিএ দায় এড়ানোর চেষ্টা করলে রাজপথে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
গত ২৩ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ীর নিমঘটু গ্রামের কৃষক অভিনাথ মারানডি ও তাঁর চাচাতো ভাই রবি মারানডি বিষ পান করলে তাঁদের মৃত্যু হয়।
পরিবারের দাবি, বিএমডিএর গভীর নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত হোসেন দুই কৃষকের বোরো ধানের জমিতে পানি দিচ্ছিলেন না। তাই তাঁরা নলকূপের সামনেই বিষ পান করেন। এ নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার দুটি মামলা করা হয়। পরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এরপর বিএমডিএ তাঁকে চাকরিচ্যুত করে।
অভিযোগ আছে, দুই কৃষকের মৃত্যুর পরে তাঁদের জমিতে লোকদেখানো পানি দেওয়া হয়েছিল। এখন ধানের শিষ বের হচ্ছে। এই সময়ে ওই দুই কৃষকের ধানের জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।