মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা ও জেলা সদরের একাংশ নিয়ে এক বিশাল বিল, যা স্থানীয় লোকজনের কাছে ‘ভাতশালা বিল’ নামে পরিচিত। আগে বছরের অধিকাংশ সময় পানি থাকলেও কালের বিবর্তনে এখন বছরের দুই থেকে তিন মাস এই বিলে পানি থাকে। বাকিটা সময় যেন বিস্তৃর্ণ ফসলের মাঠ। এই বিলের মধ্যে উঁচু স্থানে গড়ে উঠেছে বিশাল গরুর খামার।
খামারে ঢুকতেই দেখা গেল, বিশাল শেডের ভেতর দুই সারিতে গরুগুলো রাখা হয়েছে। গরম থেকে গরুগুলোকে স্বস্তি দিতে প্রতিটি গরুর মাথার ওপর বৈদ্যুতিক পাখা স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে বিকল্প হিসেবে জেনারেটরের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। খামারের পশ্চিম পাশে স্থাপন করা দুটি কাটার যন্ত্র দিয়ে ঘাস কাটছেন দুই শ্রমিক। আরেক প্রান্তে যন্ত্রের মাধ্যমে ভুট্টার গুঁড়া তৈরি করছেন আরও দুই শ্রমিক।
বিলের যে অংশে খামারটি করা হয়েছে, তা জেলা সদরের বরুণা এলাকায়। খামারের পাশে বিশাল আকারের দুটি পুকুর। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর বিলে থাকা দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের আশ্রয় হয় পুকুর দুটিতে। দুই বছর আগে স্থানীয় বিজরী গ্রামের শৌখিন খামারি সোনা মিয়া (৬৫) খামারটি গড়েছেন।
সোনা মিয়া জানান, ৩০ বছর তিনি মালয়েশিয়ায় কাটিয়েছেন। প্রায় এক যুগ আগে সেখান থেকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ঢাকার সাভার ও নবীনগরে দুটি বাড়ি আছে তাঁর। তবে শহরে মন টেকেনি। তাই স্ত্রীকে নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে এসে বাস করছেন। দুই ছেলে থাকেন মানিকগঞ্জ শহরে। প্রায় আট বছর আগে শখ করেই গ্রামের বাড়িতে সীমিত পরিসরে গরুর খামার করেছিলেন। দুই বছর আগে গ্রামের বাড়ির অদূরে বিজরী এলাকায় বিলের মধ্যে নিজের তিন বিঘা জমিতে সোনা মিয়া গ্রাম বাংলা ডেইরি ফার্ম গড়ে তোলেন।
২০টি গরু নিয়ে এই খামারের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তবে বর্তমানে ফ্রিজিয়ান, সিন্ধি, রাজস্থানি, শাহিওয়াল ও দেশি জাতের ৬১টি গরু রয়েছে খামারে। গরুর খাবারের জোগান দিতে খামারের পাশে পাঁচ বিঘা জমিতে ঘাস চাষ করছেন তিনি। ওই খামারে ছয়জন শ্রমিক কাজ করেন। খাওয়ানো থেকে শুরু করে গরুর সব পরিচর্যা তাঁরা করলেও সোনা মিয়া সারা দিন খামারেই থাকেন। এই খামারে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের গরু রয়েছে। খামারে ওজন করে বিক্রির ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রতি কেজি ৫০০ টাকা দরে গরু বিক্রি করেন তিনি।
আলাপের ফাঁকে দুই ব্যক্তি খামারটি দেখতে এলেন। তাঁদের একজন জেলা সদরের সুলতানপুর গ্রামের মো. খোকন মিয়া (৫৫)। তিনি বলেন, ‘বিলের মধ্যে এমন একটি মনোরম পরিবেশে খামারের কথা শুনে দেখতে এলাম। গরুগুলোকে প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়াতে দেখলাম। এসব গরুর মাংস খেতেও মজা হয়।’
খামারি সোনা মিয়া বলেন, কৃত্রিম পদ্ধতিতে গরু দ্রুত সময়ের মধ্যে মোটাতাজা করা যায়। তবে তিনি ভুট্টা, চালের গুঁড়া, তাজা ঘাস, খড়, খইল এবং খেসারিগুঁড়া খাইয়ে তাঁর খামারের গরুগুলোকে পালন করছেন। এতে তাঁর খামারের গরুর আকার ও ওজন তুলনামূলক কম। তবে এ নিয়ে তাঁর আফসোস নেই।
সোনা মিয়া বলেন, ‘শুধু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে আমি খামার করিনি। গরু পালন আমার শখ। পৈতৃক সম্পত্তি পাওয়ার পাশাপাশি আমিও অর্থ–সম্পদ করেছি। শহরে থেকেছি, তবে গ্রামের বিশুদ্ধ পরিবেশ অন্য কোথাও নেই। জীবনের বাকিটা সময় এই গ্রামে, এই খামারেই কাটিয়ে দিতে চাই।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মাহবুবুল ইসলাম বলেন, খামারিদের গরু লালন-পালনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে খামারিদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তাই নিষিদ্ধ ও ক্ষতিকার ওষুধ খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি এখন আর নেই বললেই চলে।