রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ছাড়াও দুস্থ রোগীদের অর্থ ও রক্তদান, বৃক্ষরোপণ, কম্বল বিতরণ, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করেন তাঁরা।
তাঁরা ২৯ জন রংপুরের পীরগাছার বাসিন্দা। কেউ শিক্ষার্থী, কেউ চাকরিজীবী। চিন্তাভাবনায় ভিন্ন হলেও ব্রত তাঁদের একটাই। বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এই ব্রত সামনে রেখে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন তাঁরা। নাম দেন বিন্দু। সেই ছোট্ট বিন্দু বছর চারেকের মাথায় আজ সিন্ধুসম না হলেও চোখে পড়ার মতো অনেক কাজ করে চলেছে।
এই যেমন পীরগাছার অনেক মানুষকে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার জন্য হাসপাতাল, ক্লিনিক কিংবা কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হয় না। বিন্দুর সদস্যরা বাড়ি গিয়ে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করে দিয়ে আসেন। শুধু বাড়িতেই নয়, এ কাজে তাঁরা ছুটে যান বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, গ্রামে-গঞ্জে। এ সময়ের মধ্যে ১৪ হাজারের বেশি মানুষের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করেছেন তাঁরা।
মানবহিতৈষী আরও অনেক কাজ করেন বিন্দুর সদস্যরা। মেধাবীদের শিক্ষা উপকরণ ও সংবর্ধনা দেওয়া, দুস্থ রোগীকে অর্থ ও রক্তদান, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৃক্ষরোপণ, শীতার্তদের মধ্যে কম্বল বিতরণ, দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বিয়েতে সহায়তা করাসহ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের কাজ করছেন তাঁরা।
রংপুর সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে পীরগাছা উপজেলার অনন্তরাম গ্রাম। ওই গ্রামে জন্ম ওমর ফারুক, আলমগীর হোসেন ও শারেখ খন্দকারের। তাঁদের মধ্যে আলমগীর হোসেন চাকরিজীবী। বাকি দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই তিনজনই বিন্দুর মূল উদ্যোক্তা।
শারেখ খন্দকার বিন্দুর সাধারণ সম্পাদক। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির জন্ম সম্পর্কে জানতে চাইলে শারেখ ফিরে যান বছর চারেক আগের এক ঘটনায়। তিনি জানান, উপজেলার নেকমামুদ গ্রামের জুলেখা বেগমের (৫২) পিত্তথলিতে পাথর ধরা পড়ে। জুলেখা বিন্দুর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ওমর ফারুকের বড় বোন রত্না বেগমের শাশুড়ি। তাঁরা তিন বন্ধু মিলে জুলেখাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখতে যান। চিকিৎসকেরা বলেন, জুলেখার অস্ত্রোপচার করতে হবে। এ জন্য ‘ও’ নেগেটিভ রক্ত লাগবে। কোথায় পাবেন রক্ত? কার কাছে যাবেন, কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না তিন বন্ধু। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা দৌড়ঝাঁপের পরও রক্তের সন্ধান পেলেন না কোথাও। অবশেষে হাসপাতালেই এক ব্যক্তির কাছে পাওয়া গেল কাঙ্ক্ষিত গ্রুপের রক্ত। সেই বিড়ম্বনার কথা ভোলেননি ওমর ফারুক, আলমগীর হোসেন ও শারেখ খন্দকার। তিনজন মিলে একটি সংগঠন গড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর পীরগাছা জে এম মডেল সরকারি বিদ্যালয় মাঠে আরও কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে বসেন তাঁরা।
গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে, তরুণেরা মাদকাসক্ত হচ্ছেন, শিক্ষা উপকরণের অভাবে অনেকেই বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। রক্তের অভাবে অনেকেই মারা যাচ্ছে। সেদিনই সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা, সমাজ বদলে কিছু একটা করবেন। ২৯ বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। নাম দেন বিন্দু। সেই বিন্দু এখন রংপুরের পীরগাছায় রক্তদাতাদের একমাত্র সংগঠন। কারও রক্তের প্রয়োজন শুনলেই বিন্দুর স্বেচ্ছাসেবকেরা ছুটে যান হাসপাতালে। বিনা পয়সায় রক্ত দিয়ে সংগঠনটির স্বেচ্ছাসেবকেরা এলাকার মানুষের কাছে আস্থা অর্জন করেছেন।
শুধু এলাকায় নয়, প্রয়োজনে নিজ খরচে রংপুর, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, বগুড়ায় গিয়ে তাঁরা দরিদ্র রোগীদের রক্ত দিয়ে আসেন। বর্তমানে সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ১ হাজার ৫০০। প্রতি মাসে সংগঠনের তহবিলে ১০০ টাকা করে চাঁদা দেন সদস্যরা। তাঁদের কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে উপজেলার কিছু ধনাঢ্য ব্যক্তিও সহযোগিতা করছেন।
‘নিঃস্বার্থ সেবার মাধ্যমে পরম আনন্দ’ স্লোগান সামনে রেখে তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। ওই ২৯ জনের মধ্যে ৪ জন চাকরি করেন, বাকিরা শিক্ষার্থী। তবে প্রতি মাসে উপজেলা সদরের ভাড়া নেওয়া একটি অফিসে সভায় মিলিত হন তাঁরা। সভার সিদ্ধান্তমতো চলে সংগঠনের কার্যক্রম।