বন্যা পরিস্থিতি

বিচ্ছিন্ন জনপদ সুনামগঞ্জ

সড়কপথে সুনামগঞ্জ শহরের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। নেই বিদ্যুৎ। মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ।

একটি শিশুকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন এক সেনাসদস্য। গতকাল সিলেটের বন্যাকবলিত গোয়াইনঘাটে
ছবি: আইএসপিআর

রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে। নদী উপচে শহরের প্রতিটি বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়েছে পানি। কোথাও কোমরসমান, কোথাও বুকসমান পানি। এ চিত্র সুনামগঞ্জ শহরের। পানিতে তলিয়ে থাকায় সড়কপথে জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। একাধিক বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ও বৈদ্যুতিক খুঁটি তলিয়ে যাওয়ায় জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহও বন্ধ আছে। মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক নেই, ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ। কার্যত পুরো জেলা এখন সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন।

গতকাল শুক্রবার রাত নামার পরপর অন্ধকারে তলিয়ে যায় সুনামগঞ্জ শহর। এ অবস্থায় ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে থাকা মানুষজন সুনামগঞ্জে আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিতে পারছেন না। সেখানকার প্রকৃত খবরও পাওয়া যাচ্ছে না।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ও পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধারে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় গতকাল সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে জানানো হয়েছে, সিলেট সদরসহ গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও কুমারগাঁও পাওয়ার স্টেশন এবং সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, দিরাই, দোয়ারাবাজার, ছাতক ও সুনামগঞ্জ খাদ্যগুদাম রক্ষায় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।

সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলা সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ। জলযানের সংকট আছে। ফলে বন্যার পানিতে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মুহম্মদ মোশাররফ হোসেন, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার

স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বানভাসি মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল সকাল থেকেই ভারী বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইতে থাকে। উজানের পাহাড়ি ঢল জেলার নদ-নদীগুলো দিয়ে নামতে থাকে। ফলে হু হু করে বাড়তে থাকে পানি। সুনামগঞ্জ শহরের সঙ্গে অন্তত নয়টি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

জেলার যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। গতকাল সকাল থেকে মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। বন্ধ হয়ে পড়েছে ইন্টারনেট সেবাও। অনেক এলাকার হাসপাতালেও পানি উঠেছে। বন্যার পানিতে অনেকে ঘরে আটকা পড়েছেন। মূলত গোটা জেলায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহম্মদ মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলা সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ। জলযানের সংকট আছে। ফলে বন্যার পানিতে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শহরের একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, জেলা শহর ছাড়াও ছাতক, দোয়ারাবাজার, সদর, জগন্নাথপুর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। বিশেষত সদর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার প্রায় ঘরেই হাঁটু থেকে কোমরসমান পর্যন্ত পানি। কোথাও এর চেয়ে বেশি পানি আছে।

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় এখন পুরোপুরি বিপর্যস্ত সুনামগঞ্জ জেলা। এবার দুর্ভোগের চিত্র এবং ক্ষয়ক্ষতি আগেরবারের চেয়ে বেশি। তবে প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা করছে মানুষের পাশে দাঁড়াতে।
মোহাম্মদ জাকির হোসেন, স্থানীয় সরকার বিভাগ সুনামগঞ্জের উপপরিচালক

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল কাদির জানান, পিডিবির অধীন সুনামগঞ্জের ৯০ হাজার গ্রাহক বর্তমানে বিদ্যুৎহীন। এর বাইরে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অধীন গ্রাহকেরাও বিদ্যুৎহীন রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।

নতুনপাড়া এলাকার বাসিন্দা মালতী রায় (৬১) বলেন, ‘আমার জীবনে অত পানি দেখছি না। সব ঘরও পানি। কেউ কোনতা রানতা পারতাছইন্যা। এক ঘর থাকি আরেক ঘরে যাওয়ন যাইতেছে না। মানুষ কষ্টে আছে!’

দোয়ারাবাজার উপজেলার বন্যাকবলিত একজন জানিয়েছেন, ঘরে যে শুকনো খাবার ছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। এখন সাতজনের পরিবারের সদস্যরা কী খাবেন, এ চিন্তায় পড়েছেন। এর চেয়ে বড় চিন্তা, যদি পানি বাড়তে থাকে, তাহলে তাঁদের টিনের ঘরটিও ডুবে যাবে।

স্থানীয় সরকার বিভাগ সুনামগঞ্জের উপপরিচালক মোহাম্মদ জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় এখন পুরোপুরি বিপর্যস্ত সুনামগঞ্জ জেলা। এবার দুর্ভোগের চিত্র এবং ক্ষয়ক্ষতি আগেরবারের চেয়ে বেশি। তবে প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা করছে মানুষের পাশে দাঁড়াতে।

গত ১৪ মে সুনামগঞ্জে প্রথম দফা বন্যা দেখা দেয়। সে সময় জেলার পাঁচটি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। সে বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই এবার দ্বিতীয় দফা বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গোটা জেলা।

ঢাবির ২১ শিক্ষার্থীকে উদ্ধার

আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক জানান, সুনামগঞ্জে ভ্রমণে গিয়ে বন্যায় আটকা পড়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ শিক্ষার্থী। তাঁরা খাবার, সুপেয় পানিসহ নানা সংকটে দুরবস্থার মধ্যে ছিলেন। শিক্ষার্থীদের দলটি তিন দিন আগে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে গিয়েছিল।

বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়। এ অবস্থায় ভ্রমণে যাওয়া শিক্ষার্থীরা সুনামগঞ্জের একটি রেস্তোরাঁয় আশ্রয় নেন। গতকাল বিকেলে শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে সুনামগঞ্জ পুলিশ লাইনসে নেওয়া হয়। রাতে তাঁদের সিলেট নেওয়ার কথা।