বিকেলে ঘরে পানি ঢোকা শুরু, রাতের মধ্যে হাঁটুপানি

সিলেট নগরের মির্জাজাঙ্গাল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে সিটি করপোরেশনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন বন্যাদুর্গত মানুষ। শুক্রবার সকালে
ছবি: প্রথম আলো

সিলেট নগরের কালীঘাট এলাকার বাসিন্দা সাদিকুর রহমান (৬০)। টানা বর্ষণ ও সুরমা নদীর পানি উপচে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে নগরের অন্য সবার মতো তাঁর ঘরেও ঢুকতে শুরু করে। রাতের মধ্যে ঘরে হাঁটুপানি জমে যায়। ঘরের আসবাবসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র উঁচু স্থানে তুলে আজ শুক্রবার সকালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে স্বজনের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন তিনি।

শুক্রবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় কালীঘাট মোড়ে। একটি ভ্যানে বালতিতে ঢাকা বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে তিনি ও তাঁর মেয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁদের পেছনে একটি রিকশায় তাঁর স্ত্রী ও ছেলে। কালীঘাট মোড়ে পৌঁছার পর ভ্যানচালক আর যেতে চাননি। পরে বাধ্য হয়ে অন্য পরিবহন খুঁজছিলেন তিনি।

সাদিকুর বলেন, ‘এমন অবস্থা গত ২৪ বছরেও দেখিনি। ১৯৯৮ সালের বন্যা দেখেছি, সে সময় এমন অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। ২০০৪ সালের বন্যায় অবস্থা একটু ভালো ছিল, কিন্তু এবার সেটা থেকে বেশি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ঘরের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে ভাতালিয়া এলাকার স্বজনের বাসার দিকে যাচ্ছি। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কল্পনাও করিনি।’ তিনি আরও বলেন, প্রায় ১০ বছর আগে তিনি নিজের বাসা তৈরি করেছেন। পানি যাতে ঘরে প্রবেশ না করে, সে জন্য তিনি আগের চেয়ে চার ফুট উঁচু করেছিলেন। এরপরও কাজ হয়নি। এবার পানি ঢুকে হাঁটুর ওপরে উঠল।

নগরের মির্জা জাঙ্গাল এলাকার বাসিন্দা অঞ্জলি রানী শীল (৫৫) তাঁর মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে বন্যার মধ্যেই হেঁটে যাচ্ছিলেন লামাবাজার এলাকার দিকে। অঞ্জলি রানী বলেন, ‘২০০৪ সালের বন্যার পর ঘর তৈরি করেছিলাম। সে সময় বন্যার কথা ভেবে ঘর উঁচু করা হয়েছিল। কিন্তু এবার তাতেও লাভ হয়নি। ঘর ছেড়ে স্বজনের বাসায় গিয়ে উঠতে হচ্ছে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ আজ শুক্রবার সকাল ছয়টার তথ্য অনুযায়ী, সুরমা নদীর দুটি ও কুশিয়ারা নদীর একটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া সারি নদের একটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার অন্যান্য নদ-নদীর পানিও ক্রমশ বাড়ছে বলে পাউবোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

ঘরে পানি ওঠায় নিরাপদ আশ্রয়ে ছুঁটছেন মানুষ। আজ শুক্রবার সকালে নগরের কালীঘাট এলাকায়

বানভাসি মানুষেরা জানিয়েছেন, বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বাড়িঘরে আটকা পড়েছেন। তাঁরা এ অবস্থা থেকে উদ্ধার চান। এ ছাড়া অনেক বন্যার্ত খাবার ও পানির সংকটে সবচেয়ে বেশি পড়েছেন। ঘরে হাঁটু থেকে গলাসমান পানি ওঠায় অনেকে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। অনেকে ত্রাণও পাচ্ছেন না। এতে তৈরি হয়েছে চরম মানবিক বিপর্যয়। পানি যত বাড়ছে, সংকটও তত বাড়ছে।

স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বন্যাকবলিত মানুষেরা জানিয়েছেন, সিলেট নগরের অন্তত ২০টি এলাকার পাশাপাশি জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, সদর, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ছয় শতাধিক গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় বেড়েছে জোঁক, সাপ ও পোকামাকড়ের উপদ্রব। চলাচলের জন্য মিলছে না নৌকা। ফলে জরুরি প্রয়োজনে কেউ ঘরের বাইরে বেরোতে পারছেন না।

একাধিক জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক উপচে পানি তীব্র বেগে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এ সড়কে ঝুঁকি নিয়ে সীমিত পরিসরে যান চলাচল করছে। অন্যদিকে সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় গোয়াইনঘাট উপজেলাও জেলা শহরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সিলেট নগরের তালতলা, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, কালীঘাট, মাছিমপুর, মেন্দিবাগ, উপশহর, তেরোরতন, যতরপুর, সোবহানীঘাট, চালিবন্দর ও ঘাসিটুলা এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার অনেক রাস্তায় পানি থই থই করছে। বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়েছে। বানের পানির সঙ্গে ভেসে আসছে ময়লা-আবর্জনা। এসব পানি থেকে দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছে।

সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, নগরের ৩১টি বিদ্যালয় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে আশ্রয় প্রার্থীদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে অবহিত করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন আন্তরিকভাবে কাজ করছে। যাঁদের বাড়িঘরে পানি উঠেছে, তাঁদের আশ্রয়কেন্দ্রে নতুবা নিরাপদ স্থানে চলে আসতে বলা হচ্ছে। খাদ্যসংকট দূর করতে দেওয়া হচ্ছে ত্রাণ সহায়তা। সেনাবাহিনী দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা শুরু করবে।