বাড়িতে স্বজন, আর বাড়ির বাইরে প্রতিবেশীদের ভিড়। বারান্দার এক কোণের চৌকিতে পড়ে আছেন জয়ন্তর মা অধিকা রানী। তাঁকে ঘিরে স্বজনদের ছোটাছুটি। কেউ হাতপাখায় বাতাস করছেন। আবার কেউ চোখে-মুখে পানির ছিটা দিচ্ছেন। আজ মঙ্গলবার দুপুরে এমন দৃশ্য দেখা গেল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত স্কুলছাত্র জয়ন্ত কুমার সিংহের (১৫) বাড়িতে।
জয়ন্ত ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ধনতলা ইউনিয়নের ফকিরভিটা বেলপুকুর গ্রামের মহাদেব কুমার সিংহের ছেলে। বালিয়াডাঙ্গীর ধনতলা সীমান্তে গত রোববার দিবাগত রাতে বিএসএফের গুলিতে নিহত নিহত হয় এই কিশোর। সে সময় তার বাবা মহাদেব কুমার সিংহও বিএসএফের ছোড়া গুলিতে আহত হন। জয়ন্তর মৃত্যুর দুই দিন হতে চলেছে।
আজ বেলা ১টার দিকে জয়ন্তদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলেকে হারানোর শোক ও আহত স্বামীর চিন্তায় অধিকা রানী এখন শয্যাশায়ী। স্বজনেরা ভিড় করছেন তাঁদের বাড়িতে। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ তাঁকে সেবাশুশ্রূষা করছেন। অধিকা রানী মাঝেমধ্যে চোখ খুলে কিছু একটা বলছেন, আর মূর্ছা যাচ্ছেন। সে সময় এক নারীকে ভিড় করা মানুষকে সরিয়ে দিতে দেখা যায়। পরে নিজের পরিচয় দিয়ে ওই নারী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর নাম সুনতি রানী। তিনি জয়ন্তর পিসি হন, জয়ন্তর বাবা তাঁর মাসতুতো ভাই। তিনি বলেন, ‘খবরটা শুনেই এইঠে চলে আসছি। দাদা তো হাসপাতালত। জয়ন্তর মা আর বোন দুইজনেই অজ্ঞান হয়ে যাচে।’ অধিকা রানী কী বলছেন জানতে চাইলে সুনতি রানী বলেন, ‘বৌদি জয়ন্তর লাশ আসছে কি না, এটার খোঁজ নিচ্ছেন।’
জয়ন্ত বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। জয়ন্তর সঙ্গে প্রতিদিন স্কুলে যেত সহপাঠী তাপস সিংহ। আজ সে স্কুলে যায়নি। জয়ন্তর লাশের অপেক্ষায় বসে আছে। তাপস বলে, ‘জয়ন্তর মুখটা শেষবারের মতো দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছি।’
জয়ন্তর বড় বোন স্মিতা রানী সিংহ একই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট ভাইকে হারিয়ে সে পাগলপ্রায়। সে কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারছে না।
লাহিড়ী বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘জয়ন্ত আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর থেকে সে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিল।’
ঠাকুরগাঁও সদরের রুহিয়া থেকে জয়ন্তদের বাড়িতে এসেছেন দিনেশ বর্মন। তিনি জয়ন্তর পিসেমশাই (মহাদেবের ভগ্নিপতি)। দিনেশ বর্মণ বলেন, ‘আজ সকালে লাশ ফেরতের খবর জানার জন্য এলাকার লোকজন ক্যাম্প কমান্ডারের (বিজিবি) কাছে গিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছেন, সন্ধ্যার দিকে লাশ ফেরত পাওয়া যেতে পারে। আমরাও সেই থেকে জয়ন্তর লাশের অপেক্ষায় আছি।’
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত রোববার গভীর রাতে ধনতলা সীমান্ত এলাকার ৩৯৩ নম্বর মেইন পিলার এলাকা দিয়ে একদল লোক স্থানীয় দালালের সহযোগিতায় ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। গতকাল দিবাগত রাত ৩টার দিকে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার সময় বিএসএফের ডিঙ্গাপাড়া ক্যাম্পের সদস্যরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি চালান। এতে জয়ন্ত ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পরে বিএসএফের সদস্যরা তার লাশ নিয়ে যান। গুলিতে জয়ন্তের বাবা মহাদেব কুমার সিংহ ও দরবার আলী নামে এক ব্যক্তি আহত হন। তাঁরা দুজন সীমান্তে এপারে চলে আসেন। পরে স্বজনেরা তাঁদের রংপুরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান।
জয়ন্তদের বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে সীমান্ত। নাগর নদীর পর চা-বাগান পেরিয়ে কাঁটাতারের বেড়া। জয়ন্ত আর তার বাবার সীমান্ত এলাকায় যাওয়ার বিষয়ে ওই এলাকার বাসিন্দা আশরাফুল আলম বলেন, ভারতে জয়ন্তর নানা ভাটি রাম বসবাস করেন। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে জয়ন্তকে সেখানে রেখে পড়ালেখা করানোর প্রস্তাব দিচ্ছিলেন। অবৈধপথে সেখানে পাঠিয়ে দিতেই মহাদেব সীমান্ত এলাকায় জয়ন্তকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর এতেই লাশ হতে হয়েছে জয়ন্তকে।
বালিয়াডাঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ কবীর মুঠোফোনে বলেন, বালিয়াডাঙ্গীর ধনতলা সীমান্ত এলাকায় নিহত জয়ন্তর লাশ ফেরতের বিষয়ে বিজিবির পক্ষ থেকে তাঁকে কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
জয়ন্তর লাশ ফেরতের বিষয়টি জানতে আজ বেলা তিনটার দিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ধনতলা বিওপিতে গিয়ে কোম্পানি কমান্ডারকে পাওয়া যায়নি। পরে বিজিবির ঠাকুরগাঁও ৫০ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানজির আহমদের মুঠোফোনে কল দিলে তাঁকেও পাওয়া যায়নি।