‘বাবারে, জানের ওপরে চলতাছি’

স্ত্রী ফজিলা খাতুন (ডানে) ও পুত্রবধূ মিনারা খাতুনের (বাঁয়ে) সঙ্গে মো. রিয়াজ উদ্দিন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঈশ্বরগঞ্জের মাইজহাটি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলাে

‘জানডা (শরীর) বালা থাহলে টাইন্যা-টুইন্যা কষ্ট কইরা চলতাম পারি। কিন্তু এক দিন যদি জান খারাপ থাহে, তাইলেই ঋণ করন লাগে। সেই ঋণ আর সহজে পরিশোধ করন যায় না। বাবারে, জানের ওপরে চলতাছি।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজীবপুর ইউনিয়নের মাইজহাটি গ্রামের বাসিন্দা রিকশাচালক রিয়াজ উদ্দিন (৬০)। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে রিকশা চালিয়ে তাঁর সংসার চলছে না। সারা দিন রিকশা চালিয়ে যে আয় হয়, তার সবই খরচ হয়ে যাচ্ছে খাবারের পেছনে। এক দিন অসুস্থ হলেই তাঁকে ঋণ করতে হয়। এ ছাড়া সরকারি কোনো সহায়তাও তিনি পান না। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে তাঁর বাড়ির সামনে রিয়াজ এসব কথা জানান।

প্রতিদিন রিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হন। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর যে আয় হয়, তা দিয়েই দিন শেষে সদাইপাতি কিনে ঘরে ফেরেন। এভাবেই চলছে তাঁর জীবন-জীবিকা। আগে খরচ চালিয়ে কিছু টাকা থাকত, এখন আর থাকে না।
রিকশাচালক রিয়াজ উদ্দিন (৬০)

রিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ভিটা ছাড়া তাঁর আর কোনো জমি নেই। প্রতিদিন রিকশা নিয়ে রাস্তায় বের হন। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর যে আয় হয়, তা দিয়েই দিন শেষে সদাইপাতি কিনে ঘরে ফেরেন। এভাবেই চলছে তাঁর জীবন-জীবিকা। আগে খরচ চালিয়ে কিছু টাকা থাকত, এখন আর থাকে না। হতদরিদ্র হলেও সরকারি কোনো সহায়তা পান না তিনি।

রিয়াজের স্ত্রী ফজিলা খাতুনও সরকারি কোনো উপকারভোগী নন। রিয়াজ জানান, ৩০ থেকে ৩৫ বছর আগে এক শিক্ষিকাকে তিনি বিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া করতেন। ওই শিক্ষিকা দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে একটি ভিজিডি (ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং) কার্ড করে দিয়েছিলেন। তারপর আর কেউ দয়া দেখাননি।

রিয়াজ উদ্দিনের দুই ছেলে। বড় ছেলে জুয়েলও বাবার মতো রিকশা বা ভ্যান চালাতেন। এখন স্থানীয় একটি ডেকোরেটরের দোকানে কাজ করেন। ছোট ছেলে স্থানীয় একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে চাকরি খুঁজছেন। কিন্তু চাকরির জন্য টাকার দরকার জানিয়ে রিয়াজ বললেন, তাঁর পক্ষে চাকরির জন্য টাকা জোগাড় করা সম্ভব নয়।

বড় ছেলে জুয়েল মিয়া ডেকোরেটরের লোক হিসেবে বরের মঞ্চ তৈরি করেন। ছেলের এ কাজের জন্য রিয়াজ গর্ববোধ করেন। এ কাজে কত টাকা পান জানতে চাইলে রিয়াজ বলেন, ‘বাবারে এইডাও জানের ওপরে চলে। কাজে যেতে পারলে ৩০০-৪০০ টাকা পায়। কিন্তু জান বালা না থাহলে কোনো আয় নাই।’

বাড়ির পাশেই জনপ্রতিনিধির বাড়ি। কিন্তু গত পাঁচ বছরে কেউ তাঁদের খোঁজ নেননি। যাঁরা তাঁদের চেয়ে সচ্ছল, তাঁরাই সরকারের সুবিধাগুলো পেয়ে আসছেন। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। আগে মোটামুটি সংসার চলত, এখন আর চালানো যাচ্ছে না।
রিয়াজ উদ্দিনের পুত্রবধূ মোছা. মিনারা খাতুন (২৪)

রিয়াজের স্ত্রী ফজিলা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, টাকা দিতে না পারায় তাঁর পরিবারের কেউ সরকারি সহায়তার কোনো কার্ড পাননি। কোনো তালিকায় তাঁদের পরিবারের কারও নাম নেই। চলমান খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির তালিকায়ও তাঁদের নাম নেই। এমনকি টিসিবির পণ্য কেনার কার্ডও পাননি তাঁরা।

শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন রিয়াজের পুত্রবধূ মোছা. মিনারা খাতুন (২৪)। মাথার কাপড় টেনে প্রথম আলোর প্রতিবেদকের সামনে এসে অনেকটা ক্ষোভের সুরে বললেন, বাড়ির পাশেই জনপ্রতিনিধির বাড়ি। কিন্তু গত পাঁচ বছরে কেউ তাঁদের খোঁজ নেননি। যাঁরা তাঁদের চেয়ে সচ্ছল, তাঁরাই সরকারের সুবিধাগুলো পেয়ে আসছেন। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। আগে মোটামুটি সংসার চলত, এখন আর চালানো যাচ্ছে না। গরিবের কেউ নেই বলে আক্ষেপ করেন মিনারা।