আশরাফ আলী (৭০) ও সাজু মিয়া (৬৫) মারা যান গত শুক্রবার। চারদিকে তখন বন্যার থই থই পানি। সুনামগঞ্জ ভাসছে বানের জলে। দাঁড়ানোর মাটি নেই কোথাও। কবরস্থানে তখন কোমরপানি। পরিবারের লোকজন দাফনের জায়গা না পেয়ে দুটি লাশই বাক্সবন্দী করে বাঁশ পুঁতে আটকে রাখেন কবরস্থানের পানিতে। লাশ যাতে ভেসে না যায়, সে জন্য পাহারা দেন তাঁরা।
ছয় দিন পর আজ বুধবার কবরস্থানের সামান্য জায়গা ভেসে ওঠায় আশরাফ আলীর লাশ দাফন করেছেন পরিবারের লোকজন। সাজু মিয়ার লাশ দাফনের মতো মাটি ভাসেনি। তাই এখনো কবরস্থানেই বাক্সবন্দী আছে সেটি।
এ ঘটনা সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের সুরমা নদীর তীরের ইব্রাহীমপুর গ্রামের। আজ দুপুরে গ্রামের কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায়, আশরাফ আলীর লাশ দাফনের কাজ চলছে। পাশেই বাক্সে ভরা সাজু মিয়ার লাশ। কবরস্থানে এখনো পানি আছে। আশরাফ আলী মারা যান আশ্রয়কেন্দ্রে। আর সাজু মিয়ার মৃত্যু হয় বানের পানির তীব্র স্রোতে ভেসে গিয়ে।
আশরাফ আলীর মেয়ে স্থানীয় ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য তানজিনা বেগম বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাতে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। তাঁদের ঘরে পানি ঢুকে যায়। এরপর গ্রামের স্কুলে আশ্রয় নেন সবাই। শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টায় আশ্রয়কেন্দ্রেই মারা যান তাঁর বাবা। তখনো প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। পানি বাড়ছিল। সকালে চার দিকে খোঁজ করে কোথাও লাশ দাফনের জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে লাশের গোসল, কাপড় পরানো শেষে পলিথিনে মোড়ানো হয়। চারজন মানুষ নৌকায় থেকে জানাজা পড়েন। এরপর লাশ কবরস্থানে নিয়ে সেখানে বাক্সবন্দী করে বাঁশ দিয়ে আটকে রাখা হয়। তানজিনা বলেন, ‘বন্যার কারণে বাবার লাশ দাফনের জায়গা পাইনি। লাশটা কবরস্থানে ভেসে ছিল। এই কষ্ট সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।’
আশরাফ আলীর ছেলে ইব্রাহিম মিয়া (৩৫) ছোট ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে শেষবারের মতো বাবার কবরে মাটি দিচ্ছিলেন। কবরস্থান থেকে বের হয়ে বলেন, ‘এখনো বাড়িতে হাঁটুপানি। আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। নাওয়া-খাওয়া হয়নি। বাবার লাশ এভাবে কবরে রেখে কীভাবে ঘুমাই বলেন! আজ লাশটা দাফন করে কষ্ট কিছুটা হালকা হয়েছে।’
আশরাফ আলীর মেয়ের জামাই সুনামগঞ্জের সংবাদকর্মী আল হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সুনামগঞ্জে আগে কখনো হয়নি। এই কদিন অনেক জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। লাশ দাফনের জন্য শুকনা কবরস্থান পাইনি।’ তাঁর শ্বশুর জারিগানের শিল্পী হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিলেন বলে তিনি জানান।
সাজু মিয়া মারা যান বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে। শুক্রবার বিকেলে তিনি সিলেট থেকে ১৫ বছর বয়সী নাতিকে নিয়ে বাসে করে সুনামগঞ্জে আসছিলেন। পথে সদর উপজেলার মদনপুর এসে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় সেখানে বাস থেমে যায়। সড়কের প্লাবিত অংশ দিয়ে তখন স্রোত যাচ্ছিল। নাতিকে নিয়ে ওই স্থানটুকু পার হওয়ার সময় তিনি স্রোতের তোড়ে ভেসে যান। লোকজন এগিয়ে গিয়ে হাওরের পানি থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন। ততক্ষণে তিনি মারা গেছেন। পরে লোকজন একটি নৌকায় করে লাশ ইব্রাহিমপুরে পাঠিয়ে দেন। সাজু মিয়ার বাড়ি শহরের বড়পাড়া হলেও ইব্রাহিমপুরে মেয়ে মিনা বেগমের বাড়িতেই তিনি থাকতেন।
মিনা বেগমের স্বামী সালাতুল মিয়া বলেন, ‘লাশ বাড়িতে আসার পর আমরা দাফন নিয়ে বিপাকে পড়ি। কোথাও মাটি নেই। সবখানে পানি আর পানি। পরে কোনোভাবে জানাজা করে কাঠের একটি বাক্সে লাশ ভরা হয়। এরপর সেটি নিয়ে কবরস্থানে ভাসিয়ে রাখা হয়। এখনো লাশ সেখানেই আছে। বুধবার কবরস্থানে গিয়ে দেখি, সামান্য জায়গা শুকিয়েছে। সেখানে একজনকে দাফন করা সম্ভব। তাই আশরাফ আলীর লাশ দাফন করা হয়েছে।’ আগামীকাল বৃহস্পতিবার সাজু মিয়ার লাশ দাফন করা হবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘লাশটা যে পেয়েছি, এটাই বেশি। মানুষজন তখন এগিয়ে না এলে লাশ হাওরের পানিতে ভেসে যেত।’
মিনা বেগম তখন আহাজারি করছিলেন, ‘আমার বাপজানের লাশ ছয় দিন ধইরা পানিত ভাইসা আছইন। মাটি নাই গো, দেশও মাটি নাই। আহারে, এই দুঃখ কোয়াই রাখতাম!’