আগামী ইউপি নির্বাচনে রাজশাহীর বাগমারার গোবিন্দপাড়া ইউনিয়নের হিন্দু ভোটারদের জন্য ‘মসলা’ তৈরি করে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট না দিলে উচিত শিক্ষা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। প্রকাশ্যে সভা ডেকে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়াতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।
২ অক্টোবর বিকেলে স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয়ের মিলনায়তনে উপজেলার গোবিন্দপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় এ ধরনের হুমকি দেন গোলাম সারওয়ার। সভার বিশেষ অতিথি হিসেবে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, এই ইউনিয়নে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২ হাজার ৮০০ ভোট রয়েছে। তাঁদের ভোট আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে নিশ্চিত করতে হবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজাতে দলীয় নেতারা তাঁদের সহযোগিতা করে থাকেন। বিভিন্ন উপহার দিয়ে থাকেন। অথচ তাঁরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দেন না। এ সময় তিনি বলেন, ‘তাঁরা প্রতিবার বেইমানি করবেন, নাকি এই নির্বাচনে ঠিক হবেন, তা জানতে চাই। যদি তাঁরা ঠিক না হন, তাহলে এবার আমাদের মসলা আছে। তাঁদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে।’
যাঁরা নৌকা প্রতীকের বাইরে ভোট দেবেন, তাঁদের ভয়ভীতি দেখানোরও পরামর্শ দিয়েছেন গোলাম সারওয়ার। তাঁদের হুমকির ভাষাও তিনি শিখিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এবার আইস্যা দ্যাখ সেন্টারে, আইস্যা দ্যাখ সেন্টারে’ বলা উচিত ছিল।
গোলাম সারওয়ারের এই বক্তব্য স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা আবু সাইদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আল মামুনের ফেসবুক আইডি থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এ জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিয়ে আলাদা সভা ডেকে এই বিষয়ে তাঁদের কথা শোনার কথা জানান গোলাম সারওয়ার। এই সভায় স্থানীয় সাংসদসহ তিনি উপস্থিত থাকবেন বলে ঘোষণা দেন। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনে স্বজাতির প্রার্থীকে ভোট দেবেন আর জাতীয় নির্বাচনে নৌকায় ভোট দেবেন, তা হতে পারে না। আগামী ইউপি নির্বাচনের আগেই এর ফয়সালা করতে হবে। ইউপি নির্বাচনে নৌকায় ভোট না দিলে তাঁদের আওয়ামী লীগ করার সুযোগ নেই। নির্বাচনের আগে এমন অবস্থা তৈরি করা হবে, যাতে তাঁরা পালানোরও পথ পাবেন না।’
তাঁরা প্রতিবার বেইমানি করবেন, নাকি এই নির্বাচনে ঠিক হবেন, তা জানতে চাই। যদি তাঁরা ঠিক না হন, তাহলে এবার আমাদের মসলা আছে। তাঁদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে।গোলাম সারওয়ার, সাধারণ সম্পাদক, বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগ
গত ইউপি নির্বাচনে এই ইউনিয়নে চারজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চতুর্থ হয়েছিলেন। এখানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রার্থী বিজন সরকার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী চার নম্বর অবস্থানে থাকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় বলা হয়, হিন্দু ভোটাররা আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দেননি।
সভায় দলীয় নেতারা ছাড়াও আসন্ন ইউপি নির্বাচনের সম্ভাব্য চেয়ারম্যান প্রার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। গোলাম সারওয়ার দলীয় প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আপনারা বিগত নির্বাচনে পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। হিন্দু ভোটারদের কাছেও যেতে পারেননি।’ যাঁরা নৌকা প্রতীকের বাইরে ভোট দেবেন, তাঁদের ভয়ভীতি দেখানোরও পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁদের হুমকির ভাষাও তিনি শিখিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এবার আইস্যা দ্যাখ সেন্টারে, আইস্যা দ্যাখ সেন্টারে’ বলা উচিত ছিল।
প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ নেতার এই বক্তব্যে উপস্থিত অনেক নেতা বিস্মিত হন। এ ছাড়া ফেসবুক লাইভ দেখেও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হলেও তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সভায় উপস্থিত দুজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, গোলাম সারওয়ার শুধু দায়িত্বশীল একজন নেতাই নন, কলেজের অধ্যক্ষও। তাঁর কাছ থেকে প্রকাশ্যে এমন বক্তব্য আশা করা যায় না।
এ বিষয়ে উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও গোবিন্দপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান বিজন কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের মতো স্বাধীনতার পক্ষের দলের নেতার কাছ থেকে এমন বক্তব্য অশোভনীয়। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্টের জন্য এমন উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। তাঁর এ ধরনের প্রকাশ্য হুমকির কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহী বিভাগের সাবেক সমন্বয়ক সুব্রত কুমার পাল প্রথম আলোকে বলেন, একটি সম্প্রদায়কে নিয়ে সরাসরি এ ধরনের বক্তব্য সমর্থনযোগ্য নয়। প্রশাসনের বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।
অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারওয়ার মুঠোফোনে দাবি করেন, তিনি হুমকি দেননি এবং কোনো মসলার কথা বলেননি। হিন্দু ভোটাররা ‘ফ্যাক্টর’, তাই তাঁদের নিয়ে আলাদাভাবে বসার কথা বলেছেন মাত্র।