নবগঙ্গা নদী

বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, বঞ্চিত মানুষ

প্রশাসন বলছে, সনাতনপুর–ভূঁইয়াপুর এলাকার নদীর ইজারা চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাঁধ দিয়ে মাছের চাষ করছেন। তাঁদের কারণে নদীপারের কেউ নদীতে নামতে পারছেন না। সম্প্রতি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় সনাতনপুর এলাকায়
 ছবি: প্রথম আলো

ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলায় এক যুগের বেশি সময় ধরে নবগঙ্গা নদীর দুই স্থানে ১০৫ একর জলাশয় ইজারা দেওয়া আছে। এসব জায়গায় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাঁধ দিয়ে মাছের চাষ করছেন। তাঁদের কারণে নদীপারের কেউ নদীতে নামতে পারছেন না। বাড়ির পাশে নদী থাকলেও এর কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না নদীর পার এলাকা সনাতনপুর, ভূঁইয়াপুর ও চাঁদপুরের বাসিন্দারা। নদী সবার জন্য অবমুক্ত করার দাবি তাঁদের।

অবশ্য জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, সনাতনপুর–ভূঁইয়াপুর এলাকার নদীর ইজারা চুক্তি নবায়ন না করে জলমহালটি অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর চাঁদপুর এলাকার জলাধারের আগামী বছর পর্যন্ত ইজারা বলবৎ থাকায় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে প্রভাবশালী যে মহলটি সনাতনপুর–ভূঁইয়াপুর এলাকায় মাছের চাষ করে আসছে, তারা এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কর্মসূচি শুরু করেছে। আবারও বরাদ্দ পেতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, নবগঙ্গা নদীর ইংরেজি অক্ষর ইউ আকৃতির বাঁকে ভূঁইয়াপাড়া ও সনাতনপুর এলাকায় একাধিক বাঁধ রয়েছে। এসব বাঁধ দিয়ে নদীর পানি আটকে সেখানে মাছের চাষ করা হচ্ছে। নদীর ধারে কুঁড়েঘর তৈরি করা হয়েছে। গোটা নদীর অংশ ছোট ছোট পুকুরে পরিণত হয়েছে।

একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নবগঙ্গা নদীর হরিণাকুণ্ডু এলাকার ভূঁইয়াপাড়া গ্রামের মোড় থেকে ভেড়াখালী গ্রামের পাশ দিয়ে ইউ আকৃতির বাঁকে পানি প্রবাহিত হতো। নদীতে পানি কমে এলে এ বাঁকে পানিপ্রবাহ কমে যেত। ইউ আকৃতির অংশে পানির প্রবাহ স্বচ্ছন্দ করতে ১৯৮১ সালে ৮০০ মিটার সোজা একটি জায়গায় খননকাজ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। জমি অধিগ্রহণ করে ওই খননকাজ করা হয়। এতে নদীর পানিপ্রবাহ সচল হয়। অপেক্ষাকৃত কম হলেও বাঁকের অংশটুকুতে তখনো স্রোত ছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সনাতনপুর গ্রামের এক ব্যক্তি বলেন, ২০০৭ সালে হঠাৎ করে নবগঙ্গা নদীর ভূঁইয়াপাড়া আর সনাতনপুর মৌজার ৪৫ দশমিক ৯১ একর জলাশয় ৩ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। বছরে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা চুক্তিতে এ ইজারা দেওয়া হয়। জনৈক জাহাঙ্গীর আলম ইজারা নিয়ে সেখানে মাছের চাষ করতে শুরু করেন। এই মাছের চাষ করতে নদীতে একাধিক বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ওই স্থানে মাছের চাষ করছেন অবনীষ হালদার নামের এক মৎস্যচাষি।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নদীর পানিতে মাছের চাষ হওয়ায় নদীপারের কেউ পানিতে নামতে পারেন না। নদীতে গোসল করতে দেওয়া হয় না। নদীর পারের অনেক মানুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁরা এখন মাছ ধরা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে মাছের পারিবারিক চাহিদা নদী থেকে মেটাতেন, তাঁরাও এখন নদীতে নামতে পারেন না।

আবদুল মান্নান নামের একজন বলেন, সবচেয়ে বেশি তাঁদের সমস্যায় পড়তে হয় খেতের ফসল নিয়ে। অনেক ফসল পানিতে পরিষ্কার করতে হয়, আবার পাট পানিতেই পচাতে হয়। এগুলো তাঁরা করতে পারেন না। যাঁরা মাছ চাষ করেন, তাঁদের নির্দেশ রয়েছে, কেউ পানিতে নামতে পারবেন না।

একইভাবে চাঁদপুর গ্রামের পাশেও ইউ আকৃতির একটি অংশে খননকাজ করে নবগঙ্গা নদীর স্রোত সোজা করা হয়। এই এলাকায় সাতটি স্থানে বাঁধ দিয়ে নদীটি সাত খণ্ডে ভাগ করে মাছের চাষ করা হচ্ছে। এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মাছের চাষ করেন। ইজারা দেওয়া জলাশয়ের পরিমাণ ৫৯ দশমিক ৩৭ একর।

নদীপারের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, নদী কাটার পরও মূল নদী সচল ছিল। নদীপারের তিন গ্রামের মানুষ এ নদীর পানি সব কাজে ব্যবহার করতেন। নদীতে গোসল করা, পাট পচানো, গরুর গোসল করানো থেকে শুরু করে সব কাজই করেছেন গ্রামের মানুষ।

ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রাজিবুল ইসলাম খান বলেন, এলাকার মানুষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নবগঙ্গা নদীর সনাতনপুর এলাকার কিছু অংশ খয়রাত হতে অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এলাকার মানুষ চাইলে চাদঁপুর এলাকায়ও একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।