ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে গতকাল বুধবার বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে ১১ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। ৮৩ থেকে সর্বোচ্চ ১৩০ কিলোমিটার বেগে প্রতি ঘণ্টায় বয়ে যাওয়া ঝড়ে কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া উঠতি আমন ধান, রবি ফসল ও মাছের ঘেরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। জলোচ্ছ্বাসে বিভাগের ছয় জেলার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোথাও কোথাও বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকেছে।
গতকাল বেলা ১১টার পর থেকেই বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে ঝড়ো হাওয়া বইতে থাকে। থেমে থেমে ৩০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার বেগে এই ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হতে থাকে। একইসঙ্গে পায়রা, বিষখালী, বলেশ্বর, কীর্তনখোলা, নয়াভাঙ্গুনিসহ প্রধান প্রধান নদ–নদীগুলোতে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবাহিত হতে থাকে। এতে বরগুনার তালতলী, সদর, পাথরঘাটা, ভোলার চরফ্যাশন ও তজুমদ্দিন, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ ভেঙে এবং কোথাও বাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়ে। এতে লোকালয় প্লাবিত হয়। ফসলের খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে ঝড়ো হাওয়ার দাপট ক্রমশ বাড়তে থাকে। ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার বেগে থেমে থেমে বাতাসের গতি বাড়তে থাকে। এরপর রাত পৌনে ১২টা পর্যন্ত বিভাগের কোথাও ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার বেগে তাণ্ডব চালায় ঘূর্ণিঝড় আম্পান। উপকূলের জেলাগুলোতে ১১ থেকে ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়।
বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ঝড়ের তাণ্ডবে ভোলা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর জেলায় অন্তত ৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, ঝড়ের তাণ্ডবে বিভাগের ছয় জেলার ৫৮টি স্থানের ৬৫০ মিটার বাঁধ পানির তোড়ে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া আংশিক ক্ষতি হয়েছে ১৬১টি স্থান। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের পরিমাণ ১৬১ কিলোমটার। নদীর পাড় ভেঙেছে ১০টি স্থানে। এর দৈর্ঘ্য দুই কিলোমিটারের বেশি। প্রাথমিক হিসাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৩ কোটি টাকার অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পাউবোর বরিশাল আঞ্চলিক প্রধান প্রকৌশলী কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী জাভেদ আহেমদ প্রথম আলোকে আজ বৃহস্পতিবার সকালে বলেন, 'আমরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে সেসব এলাকায় জরুরি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু করেছি।'
বরগুনার তালতলীর জয়ালভাঙা এলাকার বাসিন্দা মো. আলম মিয়া আজ সকালে প্রথম আলোকে বলছিলেন, 'মোগো এলাকা পানিতে তুবান অইয়্যা গ্যাছে। বাঁধ উপচাইয়্যা পানি ঢুইক্কা গ্রামের পর গ্রাম তলাইয়্যা গ্যাছে।'
তালতলী উপজেলার বড়অংকুজান পাড়া খোট্টার চর, জয়ালভাঙা, নিশানবাড়িয়া, মরা নিদ্রাসহ অনেক গ্রাম বাঁধ উপচে ভেতরে ঢোকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার অন্তত ১০ হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। তালতলী খোট্টারচর এলাকার আরেক বাসিন্দা জালাল উদ্দীন বলছিলেন, 'সিডর বড় বইন্না আছিল। কিন্তু হেই সোময়ও এতো পানি দেহি নায়। ৬১ সালের বইন্নায় খুব পানি অইছিল। এবারও হেইরহম পানি চাইরদিন থই থই হরে। ঘর-দুয়ার সব তলাইয়্যা গ্যাছে। বান্দা উপচাইয়্যা পানি ওডে।'
২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় কিছু এলাকায় বাঁধ উপচে পানি ওঠার ঘটনা ঘটেছিল। এরপর এবারই বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ার ঘটনা ঘটল।
বাঁধ উপচে পানি ঢোকার ঘটনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকৌশলীরা অনেকটা বিস্মিত। তাঁরা বলছেন, পাউবোর বাঁধের উচ্চতা চার থেকে পাঁচ মিটার। এত বড় উচ্চতার বাঁধ উপচে পানি ঢুকে পড়ার বিষয়টি উদ্বেগের। কারণ সিডরের পর এ রকম ঘটনা আর ঘটেনি।
পাউবোর বরিশাল আঞ্চলিক প্রধান কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী জাভেদ আহমেদ বলেন, 'এবারের জলোচ্ছ্বাস আমাদের জন্য একটি ভীতিকর ইঙ্গিত দিল। উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা অনেক বেড়েছে। এ জন্য এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাঁধের উচ্চতা বাড়ানাের কোনো বিকল্প নেই।'