অপারেটরদের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, সমর্থক। প্রতি ঘণ্টা পানির জন্য ১২৫ টাকার বদলে কয়েক গুণ বেশি টাকা নেন তাঁরা।
সেচের পানি না পেয়ে গত জানুয়ারিতে ক্ষোভে, দুঃখে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিলেন রাজশাহীর তানোরের এক কৃষক। তার ঠিক তিন মাসের মাথায় পানি পেতে হয়রানির শিকার হয়ে দুই সাঁওতাল কৃষক বিষপান করে আত্মহত্যা করেছেন বলে পরিবার জানিয়েছে। যত অভিযোগ, তার সবই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিয়োগ দেওয়া গভীর নলকূপের অপারেটরের বিরুদ্ধে।
কৃষকেরা বলছেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি অপারেটরদের কবজায়। তাঁদের হাতে এখন বরেন্দ্রর প্রায় চার লাখ কৃষক জিম্মি। এ অঞ্চলের কৃষকের সেচের পানি নিয়ে অপারেটররা রীতিমতো বাণিজ্য করছেন বলে অভিযোগ আছে। এসব অপারেটরের বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মী, সমর্থক বলে জানা গেছে।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা সেচের জন্য গভীর নলকূপ বসিয়ে দেয়। গভীর নলকূপ চালানোর জন্য অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হয়। শুরুর দিকে অপারেটররা কৃষকের কাছ থেকে সেচ চার্জ আদায়ের জন্য কুপন প্রথা চালু করেন। ২০০৫ সাল থেকে কৃষকদের ডিজিটাল কার্ড দেওয়া হয়। বিদ্যুৎ খরচ বাবদ কৃষকের কার্ড থেকে প্রতি ঘণ্টা পানির জন্য ১২৫ টাকা করে কেটে নেওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে নেওয়া হয় তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
তানোর পৌরসভার মেয়র ইমরুল হকের অধীনে আছে তিনটি গভীর নলকূপ। জানতে চাইলে মেয়র বলেন, কার্ড ব্যবহার করা কৃষকের জন্যই ঝামেলার। নিজেরা এসে কার্ড ঢুকিয়ে পানি নিতে হয়। সিরিয়াল পেতে দুই–তিন দিনও আসতে হয়। তার চেয়ে চুক্তি করে নিলেই কৃষকের উপকার হয়।
তানোরের কিছু স্থানে এক বিঘা জমিতে সেচের জন্য কৃষকের কাছ থেকে এক মৌসুমে ১ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করার অভিযোগ আছে। গোদাগাড়ীতে সেচের জন্য পানি বেশি লাগে। তাই সেখানে কার্ডের মাধ্যমে পানি নিতে হয় কৃষকদের। সে কার্ডও নিজেরটা ব্যবহারের সুযোগ পান না কৃষকেরা। অপারেটরের কার্ড থেকে পানি নিতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু মৌসুম শেষে বিঘাপ্রতি পাঁচ থেকে সাত কেজি করে ধান অপারেটররা আদায় করেন।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলা বিএমডিএর ১৫ হাজার ৭৯৬টি গভীর নলকূপ রয়েছে। সেচের আওতায় জমি রয়েছে ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর। কৃষকের সুবিধার জন্য সরকার সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ দেয়। প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম পড়ে ৪ টাকা ১৬ পয়সা। রাজশাহীর গোদাগাড়ী (৭১৩টি) এবং তানোরে (৫২৯টি) সবচেয়ে বেশি গভীর নলকূপ রয়েছে।
সরকার বদলায়, বদলায় অপারেটরও
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের আমলে বেশির ভাগ নলকূপ বসানো হয়। তখন বিএনপির লোকজন অপারেটর হিসেবে বেশি নিয়োগ পেয়েছিলেন। সরকার বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নলকূপের অপারেটরও বদল হয়ে যায়। সাম্প্রতিক কালে এ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
অভিযোগ করেও যখন কোনো প্রতিকার পাচ্ছিলাম না, তখন ক্ষোভে–দুঃখে আত্মহত্যার ঘোষণা দিয়েছিলাম।তানোরের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ইব্রাহিম খলিল
তানোর পৌর বিএনপির আহ্বায়ক একরাম আলী মোল্লা বলেন, তিনি দীর্ঘদিন একটি গভীর নলকূপের অপারেটর ছিলেন। এ মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা তাঁর নলকূপের দখল নেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনী সহিংসতার পর তানোরের কলমা ইউনিয়নের দুটি গভীর নলকূপ এলাকার বিএনপিপন্থী কিছু কৃষকের জমিতে পানি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তানোরের কলমা ইউনিয়নে ১০১ জন নলকূপ অপারেটর আছেন। স্থানীয় লোকজন বলছেন, কলমা ইউনিয়নের সব অপারেটরই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সমর্থক।
অপারেটরের ইচ্ছায় পানি মেলে
কোথাও কোথাও অপারেটররা নিজেদের গভীর নলকূপের আওতাধীন পুরো জমি বাইরের ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দেন। সেই ইজারাদার যে ফসল ফলান, বাদবাকি চাষিদের সেটাই মেনে নিতে হয়। অপারেটরের সিদ্ধান্ত না মানলে সেই কৃষকের জমিতে পানি দেওয়া হয় না। গত জানুয়ারিতে তানোরের কচুয়া মৌজার গভীর নলকূপের অপারেটর জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সেচ কমিটির সভাপতির কাছে সাতজন কৃষক এমন অভিযোগ করেন। অপারেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ধানের বদলে আলু চাষ করতে বাধ্য করার।
প্রধান অভিযোগকারী তানোরের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য ইব্রাহিম খলিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযোগ করেও যখন কোনো প্রতিকার পাচ্ছিলাম না, তখন ক্ষোভে–দুঃখে আত্মহত্যার ঘোষণা দিয়েছিলাম।’
সেচের পানি না পেয়ে গত সপ্তাহে গোদাগাড়ীর নিমঘটু গ্রামে দুই কৃষক বিষপানে মারা গেছেন বলে পরিবার অভিযোগ করেছে। ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় রাজশাহী নগরের সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে মানববন্ধন হয়েছে। এতে রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানার ওসিকে প্রত্যাহার, সেচ পাম্পের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনকে দ্রুত গ্রেপ্তার, সুষ্ঠু বিচার ও ন্যায়সংগত ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে।
অতিরিক্ত অর্থ আদায়
২৫ মার্চ তানোরের গোল্লাপাড়া বাজারে দুই কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, এ বোরো মৌসুমে কার্ডের মাধ্যমে পানি না দিয়ে অপারেটর চুক্তি করেছেন। এক বিঘা জমিতে সেচের জন্য কৃষকের কাছ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু তাঁদের এলাকায় কার্ডের মাধ্যমে পানি দেওয়া হলে এত টাকা লাগবে না। মোহনপুর উপজেলায় মকবুল হোসেন নামের এক অপারেটরের বিরুদ্ধে চুক্তি করে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করার অভিযোগ ওঠার পরে তাঁকে বিএমডিএ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
মেয়রের কবজায় তিন নলকূপ
তানোর পৌরসভার মেয়র ইমরুল হকের অধীনে আছে তিনটি গভীর নলকূপ। জানতে চাইলে মেয়র বলেন, কার্ড ব্যবহার করা কৃষকের জন্যই ঝামেলার। নিজেরা এসে কার্ড ঢুকিয়ে পানি নিতে হয়। সিরিয়াল পেতে দুই–তিন দিনও আসতে হয়। তার চেয়ে চুক্তি করে নিলেই কৃষকের উপকার হয়। তিনি বলেন, অপারেটরের জন্য কার্ডের ১০ টাকা ঘণ্টা হিসেবে কমিশন পাওয়ার কথা। তাঁর একটি নলকূপ মৌসুমে সাড়ে ৩০০ ঘণ্টা চলে। কমিশন আসে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এ টাকায় একজন অপারেটর কখনো কাজ করতে পারেন না।
জানতে চাইলে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ পেয়ে গত জানুয়ারিতে মোহনপুরের মকবুল হোসেন নামের এক অপারেটরের বিরুদ্ধে তাঁরা ব্যবস্থা নিয়েছেন। অভিযোগ পেলে তাঁরা ব্যবস্থা নিতে পারেন। গোদাগাড়ীর ওই দুই কৃষক যদি তাঁদের কাছে আসতেন, তাহলে তাঁরা ব্যবস্থা নিতে পারতেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁতেও শোষণ, বঞ্ছনা
সেচের নামে কৃষকদের সঙ্গে অপারেটদের বৈষম্য ও বাড়তি টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁতেও। চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিএমডিএর অধীনে ১ হাজার ৫৭৫টি ও নওগাঁয় ৪ হাজার ৪০০টি গভীর নলকূপ আছে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক টুনু পাহান বলেন, গরিব ও দুর্বল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কৃষদের ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়েই হয়ে থাকে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ]