বরিশালে মা ইলিশ রক্ষার অভিযানে একের পর এক হামলা

প্রভাবশালী লোকজনের ছত্রচ্ছায়ায় চলছে মা ইলিশ নিধন। অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার শিকার হচ্ছেন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

ইলিশ মাছ

বরিশালে মা ইলিশ রক্ষার অভিযানে গিয়ে একের পর এক হামলার ঘটনায় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে অসহায় হয়ে পড়েছেন মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা। ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার পর গত এক সপ্তাহে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর তিনটি পৃথক হামলার ঘটনায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বরিশাল সদর উপজেলার চন্দ্রমোহন ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড-সংলগ্ন কীর্তনখোলা নদী এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটে। মা ইলিশ ধরার খবর পেয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিবুর রহমান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহেদী হাসান, নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (দক্ষিণ) জাকারিয়া রহমান, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সঞ্জীব সন্যামতসহ বন্দর থানার পুলিশের ১০ সদস্যের একটি দল ওই এলাকায় অভিযানে যায়। সেখানে পৌঁছামাত্র একদল দুর্বৃত্ত অতর্কিতে তাঁদের ওপর হামলা চালায়। তারা এলোপাতাড়ি ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। হামলার মুখে আত্মরক্ষায় অভিযান পরিচালনাকারী সদস্যরা পিছু হটেন। হামলায় পুলিশের দুই সদস্য এবং তাঁদের বহনকারী একটি স্পিডবোটের চালক আহত হন।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে মেঘনার দেবুয়া এলাকায় নৌ পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশের দুই সদস্য আহত হন। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া গত রোববার মেহেন্দীগঞ্জের দুজন প্রভাবশালী ইউপি সদস্যের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনাকারী দলের ওপর আরও একটি হামলার ঘটনা ঘটে।

মৎস্য বিভাগ বলছে, হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা, বরিশাল সদরের চন্দ্রমোহন ইউনিয়ন-সংলগ্ন এলাকার কীর্তনখোলা নদী ইলিশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রমের অংশ হওয়ায় প্রজননের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব এলাকায় মা ইলিশের বিচরণ বেশি হওয়ায় অসাধু জেলেরা সেখানে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাছ ধরেন। প্রতিবছরই নিষেধাজ্ঞার সময় স্থানীয় প্রভাবশালী মৎস্য ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতায় জেলেরা রাতের আঁধারে নদীর এসব অংশে ব্যাপক হারে মা ইলিশ নিধন অব্যাহত রাখেন। এঁদের নিবৃত্ত করতে গেলেই নদীতে হামলার শিকার হচ্ছেন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, হিজলা উপজেলার হরিণাথপুর, শাওরা সৈয়দখালী, চরকিল্লা, অন্তর্বাম, দেবুয়া, কাইসমা, ধুলখোলা, আবুপুর, গঙ্গাপুর, নাছোকাঠি-সংলগ্ন মেঘনা নদীতে চলছে মা ইলিশ নিধন। একই সঙ্গে বরিশাল সদরের চন্দ্রমোহন-সংলগ্ন নদীতে রাতের জোয়ারে প্রতিনিয়ত অবৈধ কারেন্ট জাল দিয়ে ইলিশ শিকার করে আসছে স্থানীয় একটি চক্র। এঁরা পেশাদার জেলে না হলেও প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় মাছ ধরেন। তাঁদের ইঙ্গিতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে।

মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ভিক্টর বাইন বলেন, মেহেন্দীগঞ্জের চারদিকে মেঘনার শাখা-প্রশাখা, যেখানে ব্যাপক মা ইলিশের বিচরণ। এই এলাকায় প্রভাবশালী মাছ ব্যবসায়ীরা কৌশলে শিশুদের দিয়ে ইলিশ শিকার করাচ্ছেন। শিশুদের দণ্ড দেওয়ার বিধান না থাকায় তাঁরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন। এমনকি তিনিও অভিযানে গিয়ে জেলেদের ধাওয়ার শিকার হয়েছেন।

নৌ পুলিশ সূত্র জানায়, ওই এলাকার বিশাল মেঘনা নদীর আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নৌ পুলিশের ১৩ জন সদস্য রয়েছেন। কিন্তু এত স্বল্পসংখ্যক পুলিশ সদস্যকে অবস্থা সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। হিজলা নৌ পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বেল্লাল হোসেন বলেন, অবস্থা বিবেচনায় এখানে পুলিশের আরও ৩৪ জন সদস্য যুক্ত হচ্ছেন। তাঁদের দুটি এলাকায় ভাগ করে ২৪ ঘণ্টা হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার আওতাধীন মেঘনার পাহারায় নিযুক্ত করা হবে।

বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক আনিচুর রহমান বলেন, বিভাগীয় কমিশনার ও বরিশাল জেলা প্রশাসককে পরিস্থিতি জানানো হলে দুই উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

৭ দিনে ৩৩৬ জনের কারাদণ্ড

এবার ১৪ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ ধরা, বেচাকেনা, পরিবহন, বিপণন ও বাজারজাতকরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মৎস্য বিভাগ। মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় সূত্র জানায়, ১৪ অক্টোবর থেকে গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ৭৭০টি অভিযান পরিচালিত হয়। পাশাপাশি ৩৫০টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান হয়। অভিযানের সময় ৩৬৭টি মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়া অভিযানে আটক লোকজনের কাছ থেকে ৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা জরিমানা এবং ৩৩৬ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ২৮ লাখ মিটার অবৈধ কারেন্ট জাল ও ৩ দশমিক ৫ মেট্রিক টন ইলিশ।