বরকত–রুবেলের জব্দ করা বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনার জন্য পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান ওরফে রুবেল
ফাইল ছবি

অর্থ পাচার মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই বরকত-রুবেলের ১২টি বাস পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনার জন্য দুই পক্ষ পরস্পরকে দোষারোপ করছে। শহরের ওয়ারেল পাড়া এলাকার বাসিন্দা মিজান চৌধুরী এবং রুবেলের মেয়ে আফনান রাদিয়া তাঁদের বক্তব্যে একে অন্যকে দোষারোপ করেছেন। আজ বুধবার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ওই দুজন তাঁদের লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।

জব্দ করা ওই বাসগুলো কারা পুড়িয়ে দিয়েছে, তা এখনো শনাক্ত হয়নি। জেলা পুলিশ এ ব্যাপারে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

যে জায়গায় ওই বাসগুলো রাখা ছিল, সে জায়গা নিজের দাবি করে মিজান চৌধুরী তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট মৌজায় ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে কেনা ৪৬৩ শতাংশ জমির মধ্যে জোরপূর্বক ১৬০ শতাংশ জমি সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেল দখল করেন। দুজনে তৎকালীন ওসি মো. নাজিম উদ্দিনের মাধ্যমে তাঁকে (মিজান চৌধুরী) থানায় আটকে রেখে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অবৈধভাবে কয়েকটি স্ট্যাম্পে ও রেজিস্ট্রি অফিসের টিপসহি বইতে টিপ ও স্বাক্ষর রেখে রাতে তাঁকে ছেড়ে দেন। বরকত ও রুবেল ধরা পড়ার পর এ বিষয়ে তিনি আদালতে মামলা করেন।

মিজান চৌধুরী লিখিত বক্তব্যে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে মেলা করার জন্য তাঁর কিছু জমি ভাড়া নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে টিনশেড ঘর তোলেন বরকত-রুবেল। পরে মেলা না করে জোরপূর্বক দখলে নিয়ে ওই জায়গায় সাউথ লাইন পরিবহনের বাসগুলো রাখা শুরু করেন তাঁরা।

এ ব্যাপারে লিখিত বক্তব্যে রুবেলের মেয়ে আফনান রাদিয়া বলেন, তাঁর বাবা গ্রেপ্তার হওয়ার আগে মিজান চৌধুরীকে অ্যাকাউন্ট পে-চেকের মাধ্যমে বিভিন্ন জমির অগ্রিম মূল্যবাবদ প্রায় দুই কোটি টাকা দেন। প্রতিটি ভাউচারে জমির মূল্য ও চেকের বিবরণসহ মিজান চৌধুরীর স্বাক্ষর রয়েছে এবং তিনি ইসলামী ব্যাংক ফরিদপুর শাখা থেকে এই টাকা উত্তোলন করেছেন। এখন তিনি জমি লিখে দিচ্ছেন না বা টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না।

জায়গা উদ্ধারের বিষয়ে মিজান চৌধুরী বলেন, বরকত ও রুবেল দুই ভাই গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি বরকত ও রুবেলের দখল করা জায়গাগুলো ছাড়ানোর উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন। সেই সঙ্গে জমিগুলো ফেরত পেতে মামলা করেন। সিআইডির জব্দ করা গাড়িগুলো তাঁর মালিকানাধীন জায়গায় রাখার কারণে তিনি সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে গাড়িগুলো সরিয়ে নেওয়ার জন্য অথবা ওই জায়গার ভাড়া দেওয়ার জন্য লিখিতভাবে আবেদন করেন। এরপর সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের লিখিত আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ফরিদপুর পুলিশ সুপার ও তাঁর অধীন পুলিশ কর্মকর্তাদের সাহায্যে অন্যায়ভাবে দখল করা ওই জমির কিছু অংশ পুনর্দখল নিতে পেরেছেন।

মিজান চৌধুরী বলেন, ‘শত্রুতাবশত বরকতের স্ত্রী বিভিন্ন জায়গায় আমার নামে বদনাম করছেন এবং দীর্ঘদিন ধরে আমাকে হত্যার পরিকল্পনা করছেন। তা ছাড়া আমার নিজের প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের জায়গা আমি তাদের দখল থেকে পুনরুদ্ধার করায় তাঁরা আমার ওপর খুবই অসন্তুষ্ট। তা ছাড়া ওই গাড়িগুলো নিজেরাই পুড়িয়ে দিয়ে আমার নামে বদনাম ছড়াচ্ছেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা অপপ্রচার করছেন।’

রুবেলের মেয়ে আফনান রাদিয়া বলেন, ‘আমার বাবা ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মো. ইমতিয়াজ হাসান রুবেল মিথ্যা মামলায় ২২ মাস ধরে কারাগারে আছেন। কেউ অপরাধ করলে তাঁর বিচার হবে, এটাই আইনের শাসন। কিন্তু নিরপরাধ ব্যক্তিকে অপরাধী বানানোর জন্য এবং বিচারকে প্রভাবিত করার জন্য যে অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে, আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে তার তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা জানাই। নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের জিম্মায় থাকা আমাদের বাসে আগুন দেওয়া নিয়ে ফরিদপুর পুলিশের সংবাদ সম্মেলন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে মিজান চৌধুরীর মিথ্যা বক্তব্য প্রমাণ করে, বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। ভূমিদস্যু মিজান চৌধুরী নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রশাসন ও গণমাধ্যমকে ব্যবহার করছেন।’

আফনান রাদিয়া আরও বলেন, পুলিশ বাসের ইনস্যুরেন্স ও ব্যাংকের দায় সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ, যে ১২টি বাসে আগুন লেগেছে, তার কোনোটির ইনস্যুরেন্স চলমান নেই। শুধু তিনটি বাসের বিপরীতে লোন রয়েছে মাত্র ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এই ১১ লাখ টাকার জন্য কেউ তার ৩ কোটি টাকার বাসে আগুন দেবে? যে জায়গায় বাসগুলো ছিল, সেই জায়গা নিয়ে মিজান চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধ ছিল। এই জায়গা দখল করার জন্য এই ঘটনার কিছুদিন আগে স্থাপনাগুলো আদালতের অনুমতি ছাড়া বিক্রি করে দেয় এবং সেই জায়গা দখল করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এই বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে বলে তাঁদের পরিবারের ধারণা।

মিজান চৌধুরী বলেন, তিনি মনে করেন তাঁর জায়গার ওপরে রাখা জব্দ করা গাড়িগুলো অরক্ষিতভাবে থাকায় যেকোনো সময় ওই গাড়িগুলোতে পুনরায় অগ্নিসংযোগ হতে পারে। তাই যত দিন পর্যন্ত গাড়িগুলো সরানো না হয়, তত দিন পর্যন্ত পুলিশি পাহারা দরকার। তিনি বলেন, ‘প্রশাসন আমার সম্পদ ও জীবননাশের হাত থেকে রক্ষা করার আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।’

ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকায় ওজোপাডিকো গোয়ালচামট শাখার সামনে অর্থ পাচার মামলার আলামত হিসেবে বরকত-রুবেলের মালিকানাধীন সাউথ লাইন পরিবহনের ২২টি যাত্রীবাহী বাস রাখা ছিল। এলাকাটি ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে রঘুনন্দপুরে পড়েছে। ঢাকা সিআইডি মামলার আলামত হিসেবে ওই বাসগুলো জব্দ করে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জেলা পুলিশকে দেয়। ওই বাসগুলোর মধ্যে ১২টি বাস ১১ মার্চ দিবাগত রাতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল গফফার ১২ মার্চ বাদী হয়ে নাশকতার অভিযোগে মামলা করেন।

২১ মার্চ জেলা পুলিশ এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ইনস্যুরেন্সের টাকা পাওয়া ও ব্যাংকের দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অর্থ পাচার মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা বরকত-রুবেলের মালিকানাধীন ১২টি বাস পোড়ানো হয়েছে। ওই সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, বাস পোড়ানোর ঘটনার সঙ্গে ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের ঘনিষ্ঠ তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত সোমবার বিকেলে গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনের মধ্যে দুজন জহুরুল ইসলাম ওরফে জনি (২৪) ও মোহাম্মদ আলী (৪১) ফরিদপুরের এক নম্বর আমলি আদালতের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শফিকুল ইসলামের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাতে ইনস্যুরেন্সের টাকা পাওয়া ও ব্যাংকের দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বাস পোড়ানো হয় বলে তাঁরা জানিয়েছেন।

গ্রেপ্তার হওয়া জহুরুল ইসলাম গোয়ালচামট এলাকায় রাখা বরকত ও রুবেলের মালিকানাধীন ২২টি বাস দেখাশোনা করতেন। মোহাম্মদ আলী ওই বাসগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নৈশপ্রহরী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। এ ছাড়া পারভেজ মৃধা (২১) নামের অপর একজনকে এ মামলার সন্দেহজনক আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।