বরিশালের গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডের ফুটপাতে বসে বরই বিক্রি করছিলেন এক যুবক। বাজারে ভালো মানের বরই ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও ওই যুবকের বরই ১০০ টাকা দরেও লুফে নিচ্ছেন ক্রেতারা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বিষয়টি দেখার পরে যুবকের কাছে জানতে চাইলে তিনি ব্যাখ্যা করলেন কারণ।
বাসুদেব রায় নামের ওই যুবকের ব্যাখ্যায় উঠে এল কোটালীপাড়ার রামশীল ইউনিয়নের জহরকান্দি গ্রামের মানুষের ভাগ্যবদলের গল্প। বরই চাষের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছে গ্রামের ৩৫টি পরিবার। কীটনাশক ছাড়াই প্রাকৃতিকভাবে বরই উৎপাদন করায় দামও মেলে বেশি।
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার পয়সার হাট থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তরের সীমান্তবর্তী কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল ইউনিয়নের জহরকান্দি গ্রাম। প্রত্যন্ত পল্লির বিল এলাকা হিসেবে পরিচিত এলাকার মানুষের অভাব–অনটনই ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। গ্রামের মৃত মধুসূদন রায়ের ছেলে মণি মোহন রায়কে ঘিরেই জেগে উঠেছেন গ্রামের মানুষ। তাঁরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি সন্তানদের লেখাপড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
মণি মোহন রায় জানান, ২০০২ সালে তিনি স্ত্রীর বড় ভাই অরুণ ঢালীর কাছে মাগুরা বেড়াতে যান। সেখান থেকে রাজশাহীর আপেল কুলের দুটি কলমচারা কিনে বসতঘরের সামনে লাগান। দুই-তিন বছর পরেই তাতে প্রচুর ফল ধরে, যা খাওয়ার পরে বিক্রিও করেন। এরপর তিনি আরও গাছ বাড়ানোর জন্য নিজ উদ্যোগে কলম কেটে ১০টি গাছ লাগান। ওই গাছে ফল ধরার পরেই তিনি বরই চাষকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। শুরু হলো বরই চাষ অবলম্বন করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন।
২০০৮ সালে মণি মোহন পৈতৃক ২০ শতক জমিতে পুকুর করে পুকুরের চারপাশে আপেল কুলের কলম লাগান। সেই কুল বিক্রি করেই তাঁর ভাগ্যের পরিবর্তন করেন মণি মোহন। কুল চাষের আয় দিয়েই ধীরে ধীরে বাড়ান বাগান। জমি কিনে ১৫৬ শতক জমিতে পুকুর কেটে মাছ চাষ করেন। পুকুরের পাড়ে ৮০টি নারকেল ও আপেল কুলের বাগান করে বরই চাষ করেন। প্রতিবছরই কলম চারা করে বাগান বৃদ্ধি করে চলেছেন।
মণি মোহন বলেন, তাঁর স্ত্রী ও পুত্রবধূ মিলে নিজেরাই বাগান পরিচর্যা করেন। ছেলে বাসুদেব রায় বিভিন্ন বাজারে ঘুরে বরই বিক্রি করেন। বাড়িতে বসে পাইকারি বিক্রি করলে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় আর বাজারে নিজেরা বিক্রি করলে ৯০-১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা যায়। তাই ছেলে বাসুদেব বাজারে বরই বিক্রি করেন। বাগানের বরই চাষে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। তাই স্বাদ বেশি হওয়ায় বাজারে চাহিদা বেশি। চলতি মৌসুমে বরই বিক্রি করে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা লাভ হবে বলে আশা করছেন। বর্তমানে তাঁর বাগানের পরিধি ২০০ শতক। বাগানে যুক্ত হয়েছে লিচু ও আম বাগান। তাঁর সফলতা দেখে ২০১০ সালের পরে গ্রামের অন্যরাও এগিয়ে আসেন বরই চাষে।
বাসুদেব রায় বলেন, বড়ই চাষের পাশাপাশি ১৪ প্রজাতির লিচুর বাগান করেছে। আম বাগানে রয়েছে কিউজাই, পালমাই, গৌরমতি, ন্যাংড়া, হিমসাগর, লক্ষ্মণভোগসহ নানা প্রজাতির আম। বিভিন্ন শহর থেকে এসব গাছের কলম সংগ্রহ করে আম বাগান করেছেন। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার গরুর ফার্ম করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ বছর দুটি গরু পালন শুরু করেছেন।
মণি মোহন বলেন, ‘এ ব্যাপারে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের কোনো পরামর্শ বা সহায়তা পাইনি। তাঁরা পরামর্শ দিলে বাগানকে রোগবালাই থেকে রক্ষা করে ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারতাম।’
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ব্রজেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। পরামর্শ দেওয়া হয় না কথাটি সঠিক নয়। খবর নিয়ে চাষিদের সব ধরনের সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়া হবে।