বন্যার পানি এত ধীরে নামছে তিন কারণে

ফাইল ছবি: প্রথম আলো
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ডুবেছে সিলেট ও সুনামগঞ্জ। বন্যার পেছনে মোটা দাগে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলকে দায়ী করা হলেও অনেকেই হাওর এবং নিম্নাঞ্চলে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণকেও দায়ী করেছেন। এখন বৃষ্টি কমে এসেছে। এরপরও সিলেট ও সুনামগঞ্জের অনেক এলাকা থেকে বন্যার পানি নামছে না। আবার অনেক এলাকা থেকে নামলেও সেই গতি খুবই শ্লথ।

এ পরিস্থিতি ভাবিয়ে তুলেছে প্রকৌশলী, শিক্ষাবিদ, গবেষকসহ স্থানীয় ব্যক্তিদের। তাঁদের মতে, বন্যার পানি ধীরে নামার পেছনে প্রধানত তিন কারণ দায়ী। এগুলো হলো: হাওরে অপরিকল্পিত অবকাঠামো (রাস্তা, স্লুইসগেট, বাঁধ) নির্মাণ, নদীর নাব্যতা-সংকট ও হাওর ভরাট করা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাওর ব্যবস্থাপনায় সরকারকে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

বন্যার পানি ধীরে নামার জন্য হাওরগুলো ভরাট হয়ে থাকাকে দায়ী বলে মনে করেন পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাওরে যেভাবে আগে পানি নামত, এখন সেভাবে নামছে না। সুনামগঞ্জের হাওরগুলোর যদি পানি ধারণের ক্ষমতা আগের মতো থাকত, তবে সিলেটে পানি জমে থাকার সুযোগ পেত না। ভবিষ্যতে বন্যা এড়াতে সিলেটে নদী খনন করা হবে বলে জানান তিনি।

একই মত সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর এবং পরিবেশকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমদের। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, সাধারণত সিলেটের পানি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কালনী নদী দিয়ে ভৈরব হয়ে মেঘনায় গিয়ে মেশে। গত কয়েক দশকে কালনী ভরাট হয়ে পানিপ্রবাহের পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়েছে। ভরাট হয়েছে হাওরও। তাই এখন বৃষ্টিপাত কমে এলেও বন্যার পানি সহজে নামছে না।

সিলেট-সুনামগঞ্জে আগেও বন্যা হয়েছে। তবে এবারের বন্যার সঙ্গে আগেরগুলোর খুব একটা মিল নেই। আগে বন্যা হয়েছে স্বল্প সময়ের জন্য। ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়েছে। এবারের বন্যার ভয়াবহ রূপ ও পানির অস্বাভাবিক আচরণ এ অঞ্চলের মানুষ আগে দেখেননি। হাওরের প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করা লেখক-গবেষক পাভেল পার্থ এবারের বন্যার নাম দিয়েছেন ‘জলাবদ্ধ বন্যা’। তাঁর ভাষায়, এত লম্বা সময় ধরে সিলেট অঞ্চলে আগে কখনো বন্যার পানি আটকে থাকেনি। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে দুটি কারণ রয়েছে। অতিবৃষ্টি ও ঢলের পানি ধরে রাখার প্রাকৃতিক জলাধারগুলো ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়া এবং পানিপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ করা।

সুনামগঞ্জ-১ আসনের (তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশা) সাবেক সংসদ সদস্য নজির হোসেন বলেন, ‘আমরা সুনামগঞ্জের মানুষ এবার চার দিন অন্ধকারে ছিলাম। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, সভ্যতার বাইরে। এই অন্ধকার যাতে আর না আসে, সেটি নিশ্চিত করতে হলে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে হবে। সুনামগঞ্জ থেকে ভৈরব পর্যন্ত পানিপ্রবাহের পথ পরিষ্কার করে দিতে হবে। এ জন্য নদী খনন দরকার। সরকারের ২০১২ সালের হাওর মহাপরিকল্পনায় এসব আছে। এখন জরুরি বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।’

এবারের মতো বন্যা থেকে বাঁচতে নদী খননের বিকল্প নেই বলে মনে করেন হাওর ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা। তিনি বলেন, ‘নদীর মাটি নদীতে ফেলে খনন নয়। কার্যকর নদী খননের উদ্যোগ নিতে হবে। এবার বন্যার ভয়াবহতা দেখে আমরা বুঝেছি, এমন বিপদ সামনে আরও আছে।’

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় মনে করেন, যেহেতু সুনামগঞ্জ ও সিলেট ভারতের মেঘালয় এবং চেরাপুঞ্জির কাছাকাছি, তাই সমস্যাও দুই জায়গায় (সীমান্তের এপার-ওপার) একই। এ রকম পরিস্থিতিতে দুই দেশের আবহাওয়া পর্যালোচনা করে সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চলের মতো এখানেও আগাম সতর্কবার্তার ব্যবস্থা করা দরকার। এতে মানুষ আগেভাগে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে পারবে।

এদিকে সিলেটে গত মঙ্গলবার রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। এতে গতকাল বুধবার সকালে সুরমা, কুশিয়ারাসহ জেলার নদ-নদীগুলোর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বেড়েছে। তবে দুপুরের পর থেকে কমতে শুরু করেছে। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, আশা করা যাচ্ছে, বৃষ্টি আর না হলে পানি আরও কমবে। তবে সুনামগঞ্জে পানি ধীরগতিতে নামায় সিলেট থেকেও পানি নামতে সময় লাগছে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে মানুষজন ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। গতকালের হিসাব অনুযায়ী, জেলার ৪৪২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৮ হাজার ৩৬৫ আশ্রয়প্রার্থী রয়েছেন। মঙ্গলবার পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার ৪৬৪।

অন্যদিকে গত সোমবার সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় আবারও বৃষ্টি শুরু হয়েছে। উজানে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতকে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় এখানে ২৩ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। দিরাইয়ে পুরাতন সুরমা নদীর পানি আছে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপরে।

এ অবস্থায় সুনামগঞ্জবাসীর মনে নতুন করে পাহাড়ি ঢল নামার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পৌর শহরের বাসিন্দা পারভেজ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘যেভাবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তাতে আমরা আতঙ্কিত; আবার না পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়।’

তবে সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা বলেন, আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো পূর্বাভাস এখন পর্যন্ত নেই।