আর দশটা সরকারি হাসপাতালের মতোই ছিল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের পরিবেশ। ভেতরে-বাইরে নোংরা, অপরিচ্ছন্ন, দালালদের উৎপাত। সবার মধ্যে গা ছাড়া ভাব। এটা নেই, ওটা নেই। সেবার মান নিম্ন। এখন সেদিন বদলেছে।
হাসপাতালের ভেতরে–বাইরে ঝকঝকে–তকতকে। কোথাও ময়লা–আবর্জনা নেই। নেই কোনো দুর্গন্ধ। চিকিৎসক, কর্মকর্তা–কর্মচারী—সবাই সময়মতো হাসপাতালে আসেন। শুধু আসেনই না, সকালে হাসপাতালে এসে সবাই সমাবেশ করে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে দিনের সূচনা করেন। সরকারি হাসপাতাল নিয়ে রোগীদের যে বিস্তর অভিযোগ, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে তা নেই। বছর দুই হলো হাসপাতালটিতে আমূল এই পরিবর্তন এসেছে। এর নেপথ্য নায়ক একজন চিকিৎসক। তিনি হাসপাতালটির আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শামীম কবির।
সরেজমিনে একদিন
গত ৩১ অক্টোবর সকালে হাসপাতাল চত্বরে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছিমছাম সবুজ চত্বর। চিরচেনা আবর্জনার স্তূপ নেই। ড্রেনগুলোও পরিষ্কার। ময়লার ভাগাড় ছিল মূল ভবন ঘেঁষে দুটি বড় জায়গায়। তা এখন ফল-ফুলের বাগান। ভবনের চারপাশেই এমন বাগান হয়েছে। উৎকট গন্ধের বদলে বাতাসে ভেসে আসে ফুলের সুবাস। মূল ফটক থেকে ভবনের সামনের চত্বর পর্যন্ত সারি সারি বাহারি রঙের বৈদ্যুতিক বাতি। চত্বরটা পরিপাটি রাখতে প্রহরী নাসিমুল গণির ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো।
ভবনে ঢুকতেই দুটি টিকিট কাউন্টার। সামনে সেবাপ্রত্যাশী মানুষের ভিড়। দুই টিকিট বিক্রেতার দম ফেলার ফুরসত নেই। হেল্পডেস্কের সামনেও ভিড়। মাথার ওপরে ঝুলছে ডিজিটাল সাইনবোর্ড। তা জানান দিচ্ছে বিভিন্ন সেবার বার্তা। দূর থেকে কানে ভেসে আসে জাতীয় সংগীতের মধুর সুর। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দোতলায় সম্মেলনকক্ষে চিকিৎসক-নার্সদের দৈনন্দিন সমাবেশ চলছে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, সমবেত জাতীয় সংগীত পরিবেশন চলছে। শেষ হলে দৈনন্দিন কার্যসূচি উপস্থাপন করা হয়। আরএমও শামীম কবির মনোযোগ দিয়ে তা শোনেন। আগের দিনের কাজের মূল্যায়ন শেষে দিনের কার্যক্রমের নির্দেশনা দেন। এরপর সবাই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে বেরিয়ে পড়লেন।
আরএমও বললেন, ‘জাতীয় সংগীত আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করে। কারও ভেতরে দেশপ্রেম থাকলে নিজের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হন। দৈনন্দিন সমাবেশ ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনের প্রধান উদ্দেশ্য এটাই। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে প্রতিদিনই অ্যাসেম্বলির মাধ্যমে আমরা দিনের কার্যক্রম শুরু করছি। এরপর থেকে চিকিৎসক-নার্সসহ সবাই যথাসময়ে হাসপাতালে আসছেন।’
সেবায় সন্তুষ্টি
গত ১৪ অক্টোবর হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে কথা হয় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোজাম্মেল হকের সঙ্গে। তিনি বললেন, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালেই করাতে পেরেছেন। ওষুধপথ্যও হাসপাতাল থেকে পেয়েছেন। কেবিনের মেঝে ও দেয়ালে টাইলস লাগানো। শৌচাগারও পরিচ্ছন্ন। সেবার প্রশংসা করলেন শিক্ষানবিশ আইনজীবী শাহানা আফরোজও। তিনি বিছানা পাননি। বারান্দার মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। শাহানা বললেন, ‘চিকিৎসক ও নার্সরা নিয়মিত আমার খোঁজখবর নিচ্ছেন। সবচেয়ে ভালো লেগেছে হাসপাতালের দুর্গন্ধমুক্ত পরিবেশ।’ এখানে ভালো মানের বেসরকারি হাসপাতালের মতোই সেবা পেয়ে প্রশংসা করলেন আরও অনেকে।
অন্তর্বিভাগের ওয়ার্ডে প্রবেশে বেশ কড়াকড়ি এখন। রোগীপ্রতি একজন দর্শনার্থী থাকতে পারেন। এ জন্যও নিতে হয় অনুমতিপত্র। হাসপাতালে দালালদের দৃশ্যমান তৎপরতা নেই। নেই ওষুধ কোম্পানির লোকজনের অবাধ উপস্থিতিও। তাঁরা হাসপাতালে ঢুকতে পারেন সপ্তাহে তিন দিন; তা-ও বেলা একটার পরে।গোটা হাসপাতাল এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। দুই বছর আগে অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র ছিল মাত্র দুটি; এখন ২৮টি।
বদলের নেপথ্যে
দীর্ঘদিন ধরে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক নেই। মূল দায়িত্ব পালন করতে হয় আরএমওকে। ২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এখানে এই পদে শামীম কবির যোগদান করেন। তারপর থেকে বদলে যেতে থাকে জেলার ১৬ লাখ মানুষের চিকিৎসাসেবার এই প্রধান ভরসার জায়গাটি। শামীম কবির প্রথমে হাসপাতালের চিরচেনা সমস্যা শনাক্ত করেন। এরপর তা সমাধানে ছোট ছোট উদ্যোগ নিতে শুরু করেন।
জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টা ডায়াবেটিস ও ইসিজি পরীক্ষা চালু এবং যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্তকরণে অটোক্লেভ মেশিন বসানো হয়েছে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা এক্স-রে সুবিধা চালুর বিষয়টিও প্রক্রিয়াধীন। লেবার রুম ও প্যাথলজি বিভাগটি এখন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। নতুন পোস্ট অপারেটিভ কক্ষ চালু হয়েছে; সেখানেও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আছে। প্যাথলজি বিভাগে বসানো হয়েছে অটোক্লেভ মেশিন, অ্যানালাইজার ও নেবুলাইজার।
এসব উদ্যোগের স্বীকৃতিস্বরূপ আরএমও জেলা প্রশাসন থেকে সেরা ‘সুশীল সেবক’ হিসেবে স্বর্ণপদক এবং চলতি বছরের স্বাধীনতা সম্মাননা স্মারক পেয়েছেন। স্বাস্থ্য বিভাগের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক রাশেদা সুলতানা ১৩ অক্টোবর হাসপাতাল পরিদর্শনে এসেছিলেন। এ সময় তিনি হাসপাতালের পরিবেশ ও চিকিৎসাসেবা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন।তিনি আগামী মাসে স্বাস্থ্য বিভাগের বিভাগীয় সমাবেশ চুয়াডাঙ্গায় করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
শামীম কবিরের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ছয়ঘরিয়া গ্রামে। ২৫তম বিসিএস (চিকিৎসক) ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা তিনি। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাসের পর ২০০৬ সালে দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সহকারী সার্জন হিসেবে প্রথম চাকরিতে যোগদান করেন। হাসপাতালের বাইরে সামাজিক কাজেও নিজেকে নিযুক্ত রেখেছেন এই চিকিৎসক। বর্তমানে দুজন মেধাবী ছাত্রকে উচ্চশিক্ষায় আর্থিক সহযোগিতা করছেন। নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘চাকরিজীবী সেবা সংস্থা’ নামে সেবামূলক একটি সংগঠন। এই সংস্থার পক্ষ থেকে তিন বছর ধরে হতদরিদ্র কয়েকটি পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হয়।
লোকবলের সংকট, তবু বড় স্বপ্ন
১০০ শয্যার এই হাসপাতাল চলে ৫০ শয্যার লোকবলে। সেখানেও ২২টি চিকিৎসকের পদের মধ্যে ৬টি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। আবার দেশের সব সদর হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ৯টি করে চিকিৎসকের পদ আছে।চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে একটিও নেই। এ ছাড়া ৫৪ জন নার্স, ফার্মাসিস্ট, সুইপারসহ সব পদেই জনবলের ঘাটতি রয়েছে। লোকবলের স্বল্পতার কারণে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৭ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ৮ জন আয়া, ২ জন নিরাপত্তাকর্মী, ১ জন অভ্যর্থনাকর্মী ও ২ জন সুপারভাইজার নিযুক্ত করা হয়েছে।হাসপাতালের সার্বিক উন্নয়নে গঠিত দুটি ব্যবস্থাপনা কমিটি এই লোকবলের জোগান দিয়েছে। তাঁদের সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। বেতন দেওয়া হয় ওই কমিটি দুটির মাধ্যমে।
এরপরও মডেল হাসপাতালে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের। এ জন্য দরকার নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ), কিডনির ডায়ালাইসিস সেবা, আধুনিক এক্স-রে যন্ত্র ইত্যাদি। সেগুলো চালুর আগেই নিশ্চিত করতে হবে দুটি বিষয়—১০০ শয্যার অনুকূলে জনবল এবং ২৫০ শয্যার নবনির্মিত ভবন চালু।
আরএমও শামীম কবির বলেন, এই হাসপাতালের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এখন একই পরিবারের সদস্যের মতো। তাঁরা সবাই আন্তরিক সহযোগিতা করে চলেছেন। ফলে সফলতা যতটুকু এসেছে, তা সমন্বিত প্রচেষ্টার ফসল।