পুণ্ড্রনগরখ্যাত বগুড়ায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক সিনেমা হল। আগে শুধু বগুড়া শহরেই সিনেমা হল ছিল ১০টি। আর গোটা জেলায় সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ৩৮। তবে গত ১০ বছরে ভাঙা পড়েছে ৩১টি সিনেমা হল। এখন জেলায় সিনেমা হলের সংখ্যা সাত। তবে এগুলো বন্ধ। জেলা শহরে আছে দুটি সিনেমা হল। তা–ও চালু নেই। সংস্কারের জন্য একটি সিনেমা হল তিন বছর ধরে বন্ধ। অন্যটিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে তালা ঝুলছে।
সর্বশেষ করোনাভাইরাসের প্রভাবে লোকসানের মুখে ভেঙে ফেলা হচ্ছে ধুনট উপজেলা সদরের ‘সিকতা সিনেমা হল প্রাইভেট লিমিটেড’। গতকাল মঙ্গলবার এ সিনেমা হল ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে। এতে ২৮ বছরের পুরোনো এই রুপালি পর্দা থেকে চিরতরে আলো নিভে যাচ্ছে। সিনেমা হল ভেঙে সেখানে বিপণিবিতান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হলটির মালিক বলছেন, মানসম্মত চলচ্চিত্রের অভাবে দর্শকেরা হলবিমুখ হয়ে পড়ছেন। এ কারণে সিনেমা হলের ব্যবসা মন্দা। তাই লোকসানের মুখে সিনেমা হল ভেঙে বিপণিবিতান গড়ে তোলা হচ্ছে।
সিকতার রুপালি পর্দায় আলো জ্বলেছিল ১৯৯৩ সালে। অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য এস এম শাহাদৎ হোসেন ধুনট শহরের অফিসারপাড়া এলাকায় ১০ শতক জায়গার ওপর সিকতা সিনেমা চালু করেন। এই হলে প্রথম প্রদর্শিত হয় সালমান শাহ-শাবনূর অভিনীত ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ চলচ্চিত্র। প্রথম দিনেই হাউসফুল। ৬৫০ আসন কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্ত জমজমাট ছিল সিকতা। বেশ ভালো ব্যবসা হওয়া ছবির মধ্যে সালমান শাহ-শাহানাজ অভিনীত ‘সত্যের মৃত্যু নাই’; সালমান শাহ-শাবনূর অভিনীত ‘তোমাকে চাই’; মান্না অভিনীত ‘লুটতরাজ’, ‘আম্মাজান’, ‘ধর’, ‘দাঙ্গা’; শাকিব খান-অপু বিশ্বাস অভিনীত ‘মনের জ্বালা’ উল্লেখযোগ্য।
সিকতা সিনেমা হলের বর্তমান মালিক জাকির হোসেন বলেন, সিনেমা হল ব্যবসায় দর্শক–খরার শুরু ২০০৮ সালে। এরপর ঈদের মতো উৎসব আর যৌথ প্রযোজনায় মুক্তি পাওয়া কিছু ছবি প্রদর্শন করে ভালো ব্যবসা হয়েছে। সিনেমা হলে দর্শক বিমুখ হওয়ায় অন্য সময় ছবি বুকিংয়ের অর্থও ঘরে ওঠেনি।
স্থানীয় দর্শক ও সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যমুনা নদীর পারের জনপদ ধুনট উপজেলায় একসময় বিনোদনে ভরসা ছিল সিনেমা হল। দর্শক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠেছিল চারটি সিনেমা হল। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো প্রেক্ষাগৃহ ‘ক্লিওপেট্রা’। এরপর একে একে গড়ে ওঠে ‘ঝংকার’ ও ‘সিকতা’ সিনেমা হল। উপজেলা সদরের বাইরে গোসাইবাড়ি বাজারে চালু হয় ‘কাজল’ সিনেমা হল। তবে সবার আগে বন্ধ হয় কাজলই। এরপর ভাঙা পড়ছে সিকতা। আর অনেক আগে থেকেই বন্ধ ‘ক্লিওপেট্রা’ ও ‘ঝংকার’।
ঝংকার সিনেমা হলের মালিক মো. ঈসা খান বলেন, ১৯৮৪ সালে উজ্জ্বল-শাবানা অভিনীত ‘নসীব’ ছায়াছবি প্রদর্শনের মাধ্যমে ঝংকারের রুপালি পর্দা জ্বলে ওঠে। ৬৫০ আসনের এই সিনেমা হলে হাউসফুল ব্যবসা হয়েছে ইলিয়াস কাঞ্চন-অঞ্জু অভিনীত সাড়াজাগানো ছায়াছবি ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ও সোহেল রানা-সুচরিতা অভিনীত ‘অস্বীকার’। ২০১২ সালের পর টানা দর্শক–খরা চলে। এ অবস্থায় কয়েক বছর ধরেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সিনেমা হলের ব্যবসা। শুধু ঈদ উৎসবকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে ছায়াছবি প্রদর্শন। করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের মার্চ থেকে পুরোপুরি বন্ধ তাঁর সিনেমা হলটি।
হল ভেঙে ২০০ আসনের একক পর্দার অত্যাধুনিক সিনেপ্লেক্স তৈরির ইচ্ছা ঈসা খানের। মানসম্মত ছবি না পাওয়া গেলে সিনেমা হলের যতই উন্নয়ন করা হোক না কেন, কোনোভাবেই সিনেমা হলের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, সরকার যৌথ প্রযোজনার ছায়াছবি মুক্তির উদ্যোগ না নিলে সিনেমা হল ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে নয়।
সিনেমা হল একসময় নির্মল বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বলে মনে করেন ধুনট থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক আয়নাল হক। বলেন, একসময় সপরিবার হলে বসে নন্দিত নানা সিনেমা উপভোগ করা যেত। এখন সুস্থ বিনোদনের চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় না। একসঙ্গে হলে বসে সিনেমা দেখারও পরিবেশ নেই। তবে একের পর এক সিনেমা হল ভাঙা পড়লে যুবসমাজ মাদকের মতো নানা সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়বে।
আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বাধ্য হয়ে হল ভেঙে বিপণিবিতান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানালেন সিকতা সিনেমা হলের মালিক জাকির হোসেন। তিনি আরও বলেন, ভালো গল্পের ছায়াছবি নেই, ছবিতে নেই ভালো সংলাপ, নেই ভালো গান ও অভিনয়। এ অবস্থায় অনেকটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলছিল সিনেমা হলের ব্যবসা। ২০১৮ সাল থেকে শুধু ঈদ উৎসবে চালু রাখা সম্ভব হয় সিনেমা হলটি। সর্বশেষ ২০১৯ সালের পবিত্র ঈদুল ফিতরে প্রদর্শিত হয় ‘বেপরোয়া’ ছায়াছবি। এতে তাঁকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। হলের পুরোনো মাল নিলামে বিক্রির জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলেন। মাত্র চার লাখ টাকায় তা বিক্রি করতে পেরেছেন।