স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর মধ্যরাতে মালিক-শ্রমিক নেতারা পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও বগুড়া থেকে দূরপাল্লার ও অভ্যন্তরীণ সড়কপথে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কোনো ধরনের যান চলাচল করছে না।
দ্বিতীয় দিনের মতো সব সড়কপথে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক, ট্যাংকলরি, পিকআপ ভ্যান, কাভার্ডভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।
অন্যান্য দিন ভোররাত থেকে সকাল আটটার মধ্যে বগুড়া থেকে রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় প্রায় ৩০টি কোচ। এ ছাড়া বগুড়া হয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের সব সড়কপথে এবং উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে কয়েক শ বাস চলাচল করে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকাল আটটা পর্যন্ত সড়ক–মহাসড়কে কোনো বাস চলাচল করতে দেখা যায়নি। বন্ধ রয়েছে অভ্যন্তরীণ সব সড়কপথের বাসও। বাসের সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পণ্য পরিবহনের সব ধরনের ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ, ট্যাংক–লরিসহ সব ধরনের যান। চলাচল করছে না মাইক্রোবাস, ব্যক্তিগত গাড়ি এমনকি সিএনজিচালিত অটোরিকশাও। এতে সাতসকালে গন্তব্যে বের হয়ে দ্বিতীয় দিনের মতো সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। যানবাহন না পেয়ে হেঁটে, রিকশা-ভ্যানে গন্তব্যে রওনা দিতে দেখা যাচ্ছে যাত্রীদের।
নতুন সড়ক পরিবহন আইন স্থগিতসহ কয়েকটি দাবিতে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পণ্য পরিবহন ঐক্য পরিষদ বুধবার থেকে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বুধবার সকাল থেকে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন জেলা পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা।
ধর্মঘটে দিনভর দুর্ভোগর পর বুধবার মধ্যরাতে ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন পরিবহন নেতারা। পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে সেই ঘোষণার পরও বগুড়া থেকে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রেখেছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা।
ধর্মঘটের কারণে বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো বন্ধ রয়েছে বগুড়া থেকে জয়পুরহাট, রংপুর, নওগাঁ, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, নাটোর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ-নগরবাড়ী, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এবং উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গের সড়কপথে সব ধরনের বাস চলাচল। বগুড়া হয়ে ঢাকা-নওগাঁ, ঢাকা-জয়পুরহাট, ঢাকা-রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় দূরপাল্লার বাস চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
দ্বিতীয় দিনের দুর্ভোগের চিত্র
শহরের সাতমাথায় ঢাকাগামী বাস কাউন্টার, ঠনঠনিয়া–ঢাকা বাস টার্মিনাল, চারমাথা এবং বনানী মোড়ের দূরপাল্লার কাউন্টারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অন্যদিন সকাল থেকেই এসব কাউন্টার যাত্রীদের ভিড়ে সরগরম থাকলেও আজ এসব কাউন্টার সকাল থেকেই বন্ধ। ঠনঠনিয়া বাস টার্মিনালে দেখা গেছে, সারি সারি দূরপাল্লার বাসের লাইন। বাসের জন্য আসা যাত্রীরা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
সাতমাথায় এসআর ট্রাভেলসের কাউন্টারের সহকারী ব্যবস্থাপক সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, দিনেরাতে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রুটে এসআর ট্রাভেলসের এসি-নন এসি প্রায় ১০০ কোচ চলাচল করে। বুধবার পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সব রুটে দূরপাল্লার কোচ চলাচল বন্ধ ছিল। ধর্মঘট প্রত্যাহার হলেও বাস চলাচল শুরুর কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
ভুক্তভোগীরা জানান, চারমাথা টার্মিনাল থেকে জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা ছাড়াও রংপুর এবং খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় কিছুক্ষণ পরপর বাস ছেড়ে যায়। কিন্তু সকাল থেকেই কোনো রুটের বাস ছেড়ে যায়নি। বিভিন্ন জেলা থেকে কোনো বাস আসেনি।
বাস না পেয়ে হাজারো যাত্রী সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গন্তব্যস্থলে যেতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। দূরের গন্তব্যে পৌঁছার জন্য যাত্রীদের ভরসা এখন ইজিবাইক আর রিকশা ভ্যান।
এ বিষয়ে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকনেতারা বলেন, ধর্মঘট প্রত্যাহারের কথা তাঁরাও শুনেছেন। কিন্তু গাড়ি কখন থেকে চলবে, সে ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বগুড়ার হাইওয়ে পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মহাসড়কে দূরপাল্লার ও অভ্যন্তরীণ রুটের বাস এবং পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত মহাসড়কে সিএনজি অটোরিকশা চলাচলে আপাতত কঠোর না হওয়ার জন্য হাইওয়ে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সবজির দামে ধস
পরিবহন ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বড় পাইকারি সবজির মোকাম বগুড়ার মহাস্থান হাটে। এই হাটে শীতকালীন অধিকাংশ সবজির দাম কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। হাটে শীতের নতুন সবজির দাম পড়ে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা।
সবজির পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদারেরা বলছেন, মহাস্থান থেকে সারা বছর রেকর্ড পরিমাণ সবজির জোগান যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার, চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার এবং সিলেটে। ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকায় মোকাম থেকে সবজি পাঠানোও অনিশ্চিত। আড়তে দু-এক দিনের বেশি সবজি মজুত করাও সম্ভব নয়। এ কারণে অনেক আড়তদার হাত গুটিয়ে বসে রয়েছেন। কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়েই কিছু সবজি কিনেছেন। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সবজির চাহিদা কমে যাওয়ায় দুই দিনের ব্যবধানে সব ধরনের সবজির দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মঙ্গলবার মহাস্থান হাটে পাইকারি পর্যায়ে বেগুন ২৮ টাকা ও মুলা ৩০ টাকা কেজি, ফুলকপি ৬০ ও বাঁধাকপি প্রতিটি ২২ টাকা, পাকড়ি জাতের নতুন আলু বিক্রি হয়েছে ২০০ ও পুরোনো আলু ২৯ টাকা, পেঁয়াজপাতা ১০০, শসা ২০০, বরবটি ২২, পেঁপে ১৫, পটল ৩৮, শিম ৪০, টমেটো ৬০, ধনেপাতা ৫০, পালংশাক ৩০, কাঁচা মরিচ ৩০, মিষ্টিকুমড়া ২৮, ছাঁচি লাউ প্রতিটি ৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে এই হাটে বেগুন ১০, মুলা ১২, ফুলকপি ৩০, বাঁধাকপি ১২ টাকা, পাকড়ি জাতের নতুন আলু ১০০ টাকা, পুরোনো আলু ২২, পেঁয়াজপাতা ৬০, শসা ৭৫, বরবটি ১৫, পেঁপে ১০, পটোল ২৫, শিম ৩০, টমেটো ৪৫, ধনেপাতা ৪০, পালংশাক ২০, কাঁচা মরিচ ২৫, মিষ্টি কুমড়া ১৮, ছাঁচি লাউ ২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
গতকাল মহাস্থান হাটে সবচেয়ে বেশি কমেছে শীতকালীন সবজি মুলা ও বেগুনের দাম। দুদিন আগে বিক্রি হওয়া ২৮ টাকা কেজির বেগুন ১০ টাকায় নেমে আসে। আর ৩০ টাকা কেজির মুলার দর পড়ে তা ১২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ৬০ দরের প্রতিটি ফুলকপি অর্ধেকে নেমে এসে আজ ৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়। এক কেজি ওজনের বাঁধাকপি প্রতিটির দাম ১০ টাকা কমে আজ ১২ টাকায় বিক্রি হয়। নতুন পাকড়ি আলুর দাম অর্ধেক কমে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। মহাস্থান হাটে এক কেজি শসার দাম ছিল ২০০ টাকা। ক্রেতা না থাকায় সেই শসা আজ ৭৫ টাকায় নেমে এসেছে। তবে কমেছে অন্যান্য সবজির দাম।
মহাস্থানহাটে সবজি বিক্রি করতে আসা শিবগঞ্জের বেড়াবালা গ্রামের কৃষক হায়দার আলী বলেন, দুদিন আগে খেত থেকে শসা তুলে এনে বিক্রি করেছি ২০০ টাকা কেজি দরে। আজ দাম ৭৫ টাকা। মঙ্গলবার খেত থেকে ৫ মণ ফুলকপি তুলে এনে বিক্রি করেছি ৬০ টাকা কেজি দরে। সেই ফুলকপি আজ ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
জানতে চাইলে মহাস্থান কাঁচা ও পাকামাল আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, বাজারে ছোট-বড় ৭০ থেকে ৮০টি আড়ত রয়েছে। শীতকালীন সবজি উঠতে শুরু করেছে। এখন প্রতি হাটে এখানে গড়ে ৫০ ট্রাক সবজির আমদানি হচ্ছে। মঙ্গলবারও সবজির দাম ছিল চড়া। ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকায় আড়ত থেকে দূরদূরান্তে সবজির ট্রাক পাঠানো যাচ্ছে না। ফলে পুঁজি হারানোর ভয়ে ব্যবসায়ীরা সবজি কেনার সাহস পাচ্ছেন না।
পেঁয়াজের দাম কেজিতে আবার বেড়েছে ২০ টাকা
যানবাহন চলাচল বন্ধের প্রভাব পড়েছে বগুড়ার পাইকারি পেঁয়াজের বাজারে। উত্তরবঙ্গের অন্যতম পেঁয়াজের পাইকারি বাজার বগুড়ার রাজাবাজারে গত রোববার এক কেজি মিয়ানমারের পেঁয়াজ পাইকারি পর্যায়ে দাম ছিল ১৮০ এবং খুচরা বাজারে ২২০; দেশি পেঁয়াজ পাইকারি ১৯০ এবং খুচরা বাজারে ২৪০ টাকা। সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় গত সোমবার একই বাজারে মিয়ানমারের পেঁয়াজ পাইকারি ১৪০ এবং খুচরা ১৬০, দেশি পেঁয়াজ পাইকারি ১৬০, খুচরা ২০০ টাকা এবং আরও এক দিন পর মঙ্গলবার মিয়ানমারের পেঁয়াজ পাইকারি পর্যায়ে ১২০ এবং দেশি পেঁয়াজ ১৪০ টাকায় নেমে আসে। খুচরা পর্যায়ে ১৩০ ও ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
কিন্তু পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সরবরাহ কমে যাওয়ায় পাইকারি ও খুচরা উভয় পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম আবারও ঊর্ধ্বমুখী। আজ বৃহস্পতিবার সকালে পাইকারি বাজারে এক কেজি মিয়ানমারের পেঁয়াজ ১৪০ এবং দেশি পেঁয়াজ ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। খুচরা বাজারে এ পেঁয়াজের দাম ১৬০ থেকে ১৯০ টাকায় উঠেছে। দুই দিনের ব্যবধানে এক কেজি পেঁয়াজের দাম ২০ টাকা বেড়েছে।
জানতে চাইলে রাজাবাজার আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিমল প্রসাদ রাজ বলেন, সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় পেঁয়াজের দাম মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রতি কেজিতে ৮০ টাকা কমেছিল। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সরবরাহ কমে যাওয়ায় প্রতি কেজিতে আবারও ২০ টাকা বেড়েছে। ট্রাক চলাচল শুরু না হলে ব্যবসায়ীদের গুদাম শূন্য হয়ে পড়বে। তখন দাম আরও বাড়বে। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে পেঁয়াজের বড় চালান আটকে আছে, পাবনা থেকেও পেঁয়াজ আসছে না।