মরুর দেশের ফল ‘ত্বিন’। এটি ডুমুরজাতীয় একধরনের ফল। স্বাদে খুব মিষ্টি ও রসাল হয় এই ফল। পুষ্টিগুণে ভরা এই ফল মধ্যপ্রাচ্যে অনেক জনপ্রিয়। মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয় এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। বাংলাদেশে এটি ড্রাই ফ্রুট হিসেবে আমদানি হয়ে থাকে। পবিত্র কোরআনে এই ফলের উল্লেখ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশে অনেকে এই ফলের বাণিজ্যিক চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন। এর মধ্যে বগুড়ার তরুণ সোয়েব সাদিক (৩৩) অন্যতম সফল একজন।
করোনার সময়ে সিঙ্গাপুরফেরত সোয়েব গ্রামের বাড়িতে ফিরে ত্বিন চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন কেবল বাণিজ্যিক লাভের লক্ষ্যে নয়, তিনি ত্বিন চাষের মাধ্যমে শিক্ষিত বেকার তরুণদের ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন দেখছেন। সেই সঙ্গে পুষ্টিগুণে ভরপুর বিদেশি এই ফল দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলতে দীর্ঘমেয়াদি নানা পরিকল্পনা নিয়েছেন। আর এ জন্য বগুড়াসহ দেশের সব প্রান্তে ত্বিন চাষ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি তরুণদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে ত্বিনের চারা উৎপাদন করে কম টাকায় বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন। স্থানীয় তরুণেরা সোয়েবের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে ত্বিন চাষে আগ্রহীও হচ্ছেন।
ভারত, তুরস্ক, মিসর, জর্ডান ও যুক্তরাষ্ট্রে এই ফল আঞ্জির নামে পরিচিত। এর আরবি নাম ত্বিন। গাছপাকা এক কেজি ত্বিন ফলের গড় বাজারমূল্য ১ হাজার টাকা। এই ফলের গাছ ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। চারা লাগানোর তিন মাসের মধ্যে গাছে শতভাগ ফল ধরে। প্রথম বছরে ১ কেজি, দ্বিতীয় বছরে ৭-১১ কেজি, তৃতীয় বছরে ২৫ কেজি—এভাবে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে টানা ৩৪ বছর পর্যন্ত ফল দিতে পারে একটি ত্বিনগাছ। আকারে দেশীয় ডুমুরগুলোর চেয়ে বেশ বড় হয়। আর পাকলে বেড়ে দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ হয়। আঁটি ও বিচিহীন এই ফল আবরণসহ খাওয়া যায়।
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার আড়িয়া গ্রামে সোয়েব সাদিক দুই বিঘা জমিতে ত্বিন ফলের বাগান করেছেন। করতোয়া নদীর তীরে এই বাগানে ৬০০ ত্বিনগাছ ছাড়াও ফাঁকে ফাঁকে শোভা পাচ্ছে ৩০টি চায়না কমলার গাছ, ১০০টি মাল্টার গাছ, ৫০টি বল সুন্দরী কুল এবং ১ হাজার অ্যালোভেরার গাছ। প্রস্তুতি চলছে থাইল্যান্ডের জি-৯ কলা এবং সূর্যডিম আমগাছ লাগানোর।
বাগানের চারদিকে বেড়া। এক পাশে পাহারাদারের ঘর। খেতের মাঝখানে মাচানের আদলে ছাউনিঘেরা বিশ্রাম শেড। বাগানের গাছে গাছে লকলক করছে সবুজ পাতা। প্রতিটি পাতার গোড়ায় ঝুলছে ত্বিন ফল। দু-একটি ফল পাকতে শুরু করেছে। পাকা ফল রসে টসটস করছে।
৭ ডিসেম্বর দুপুরে হাজির হই সোয়েবের বাগানে। এ সময় দেখা গেল, সোয়েব তাঁর কয়েকজন বন্ধু নিয়ে বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ বৈদ্যুতিক মোটরে লাগানো পাইপ থেকে ত্বিনগাছে পানি ছিটাচ্ছেন, কেউ গাছের নিচে নিড়ানি দিচ্ছেন। এ সময় কথা হলো উদ্যোক্তা সোয়েব সাদিকের সঙ্গে।
সোয়েব বলেন, মরুর দেশের ফল বগুড়ার মাটিতে চাষ করতে গিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। মাটিতে জৈব ও ভার্মি কম্পোস্ট সার ছাড়াও বালু, তুষ, ছাই মিশিয়ে ফল উৎপাদনের উপযোগী করে তুলতে হয়েছে। প্রথম মৌসুমেই সফল হওয়ায় সবাই জানছেন এই বাগানের কথা। অনেকেই দেখতে আসছেন। নিজেরাও বাগান করার জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ত্বিনবাগান ও চাষপদ্ধতি জানতে অনেকেই ভিড় করছেন। চারা নেওয়ার আগ্রহের কথা জানাচ্ছেন। আগামী মৌসুমে বাগান থেকে কলম চারা উৎপাদন শুরু করবেন।
ত্বিন চাষে কেন আগ্রহী হয়ে উঠলেন প্রশ্নে সোয়েব বলেন, রাজধানীর মিরপুরের বাঙলা কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক পাস করেছিলেন। ভাগ্যান্বেষণে চার বছর আগে পাড়ি জমিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরে। সেখানে প্রথমে চাকরি করতেন একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে। পরে পরিচিত এক বাংলাদেশি বন্ধুর সঙ্গে প্রবাসী শ্রমিকদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রশিক্ষণকেন্দ্র খোলেন। সেই থেকে তাঁর প্রশিক্ষণ দানে আগ্রহ তৈরি হয়। এতে ভালোই আয়রোজগার চলছিল। সেখানে ফলের ব্যবসায়ী তুরস্কের যুবক আলী হোসেনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তাঁর। আলী একদিন তাঁকে সুমিষ্ট একটি ফল খেতে দেন। ফলের স্বাদ মুগ্ধ করে তাঁকে। ফলের নাম জানতে চান। বন্ধু আলী বলেন, এটি মরুর দেশের ত্বিন ফল। কেউ কেউ বেহেশতের ফলও বলে থাকেন। পবিত্র কোরআন শরিফের সুরা আত-ত্বিনেও এই সুমিষ্ট ফলের কথা উল্লেখ রয়েছে। সোয়েব সেদিনই সিদ্ধান্ত নেন, কখনো দেশে ফিরলে ত্বিন ফল চাষ করবেন। সেই আগ্রহ থেকেই তুরস্কের বন্ধু আলীর কাছ থেকে ত্বিন ফলের চাষপদ্ধতি শিখে নেন।
করোনার সংক্রমণ ও বিধিনিষেধে সিঙ্গাপুরে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়েন সোয়েব। কূলকিনারা না পেয়ে এ বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে ফেরেন। গ্রামে ফিরে সময় কাটছিল না। তখন মনে পড়ে আরব্য ফল ত্বিন চাষের স্বপ্নের কথা। যেই সিদ্ধান্ত, সেই কাজ। দুই বিঘা জমি ত্বিন চাষের জন্য প্রস্তুত করেন। তুরস্কের বন্ধু আলীর কাছ থেকে সংগ্রহ করেন টিস্যু কালচার করা মাতৃকলম ৩৫০টি ত্বিনগাছের চারা। এরপর জানতে পারেন, গাজীপুরের মডার্ন অ্যাগ্রো ফার্ম অ্যান্ড নিউট্রিশনেও রয়েছে এই ফলের চারা। সেখান থেকে সংগ্রহ করেন আরও ২৫০টি কলম চারা। এক মাস যেতে না যেতেই গাছে ফল ধরতে শুরু করে। সোয়েব নিজেই বাগান দেখভাল করেন, গাছের পরিচর্যা করেন, নিজ হাতে সেচ দেন। গ্রামের শিক্ষিত আরও কয়েকজন বেকার তরুণ তাঁর সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখান। তাঁরাও এখন সোয়েবের সঙ্গে বাগান পরিচর্যা করছেন। এভাবে করোনার আকাল সোয়েবকে কৃষি উদ্যোক্তা বানিয়েছে।
সোয়েব আশা করছেন, পরের বছর কমপক্ষে ৩ হাজার কেজি ত্বিন ফল বিক্রি করে আয় হবে ৩০ লাখ টাকা। তৃতীয় বছরে প্রতিটি গাছে গড়ে ২৫ কেজি হিসাবে ১৫ হাজার কেজি ফল উৎপাদিত হবে। সেই হিসাবে তৃতীয় মৌসুমে বাগান থেকে আয় হবে দেড় কোটি টাকা। ফল উৎপাদন ছাড়াও প্রতিবছর প্রতিটি গাছ থেকে ২০টি চারা টিস্যু কালচার করে উৎপাদিত হবে। প্রতিটি চারার বাজারমূল্য ৫০০ টাকা। এভাবে বাগান থেকে কমপক্ষে ৩০ বছর ফল উৎপাদিত হবে। গাছের বয়স যত বাড়বে, ফল তত বেশি ধরবে, বাগানে আয়ও বাড়বে।
সোয়েবে বলেন, ত্বিন ফলের এখনো বাজার তৈরি হয়নি দেশে। তিনি তাঁর উৎপাদিত ত্বিন ফল সিঙ্গাপুরে রপ্তানির চিন্তা করছেন। তিনি আরও বলেন, এই ফল বিদেশ থেকে আমদানি হয়। সংরক্ষণ সুবিধার জন্য নানা রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে। আমদানি-নির্ভরতা কমাতে ঘরে ঘরে খামারি তৈরি করতে তিনি নতুন উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও স্বল্পমূল্যে চারা সরবরাহ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এভাবে দেশে ত্বিন অর্ধেক মূল্যে বিক্রি সম্ভব হবে। তখন নিম্ন আয়ের মানুষও এই ফল খেতে পারবেন। আগামী রমজান মাস থেকে প্যাকেজিং করে বগুড়া ছাড়াও রাজধানীতে এই ফল বিক্রি করবেন বলে জানান সোয়েব।
সোয়েব সাদিক বলেন, ত্বিন ফল চাষ হয় আরব দেশগুলোর মরুভূমি অঞ্চলে। বগুড়ার লাল মাটিতে ত্বিন চাষ ছিল কিছুটা অসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু সিঙ্গাপুর থাকতেই বুকের ভেতরে স্বপ্ন পুষে রেখেছিলেন ত্বিন চাষ করবেন। স্বপ্নপূরণে মাটি কোনো বাধা হতে পারেনি। সেই ক্ষেত্রে বগুড়ার লাল মাটিকেই মরুভূমির মাটিতে রূপান্তর করেছেন।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে সোয়েব বলেন, চারা লাগানোর আগে প্রথমে দুই বিঘা জমিতে দুই কেজি চুন ছিটিয়ে দিতে হয়েছে। দ্রুততম সময়ে গাছ বৃদ্ধি করার জন্য জমিতে ইচ্ছেমতো জৈবসার ও ভার্মি কম্পোস্ট, ২০ কেজি টিএসপি, ২০ কেজি ডিএপি এবং ১০ কেজি পটাশ সার, এক বস্তা হাড়ের গুঁড়া ছিটিয়েছেন। মাটির রস শুষ্ক ও আঠালো মাটি ঝরঝরে করতে নীলফামারীর ডোমার থেকে আনা মোটা বালু এবং চিকন বালু ছিটিয়েছেন। পরে হালচাষের পর ধানের কুড়া, চাতালের ছাই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে চারা লাগানোর জন্য বেড তৈরি করেছেন। এরপর আড়াআড়ি এবং জিগজ্যাগ পদ্ধতিতে এক গাছ থেকে আরেক গাছের দূরত্ব ৭ ফিট রেখে দুই মাস বয়সী কলম চারা রোপণ করেছেন। প্রথম এক মাস প্রতিদিন গাছে হাত-ঝরনা দিয়ে পানি ছিটিয়েছেন। ১০ দিনের মাথায় প্রতিটি গাছে পাতার গোড়ায় গোড়ায় সবুজ ফল ধরেছে। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে গাছে ফল পাকা শুরু হবে। তখন ফলের রং লাল, খয়েরি ও মেরুন হবে। ফল পাকলেই খেত থেকে তা তোলা ও বিক্রি হবে।
সোয়েবের বাগানে কথা হয় পুণ্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আল ইমরানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই বছর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোয়েব সাদিকের সঙ্গে পরিচয়। সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে তাঁর ত্বিন চাষের উদ্যোগের কথা জেনে মরুর দেশের এই ফল সম্পর্কে আগ্রহী হন তিনি। এরপর তাঁর সঙ্গে সার্বক্ষণিক বাগানে গিয়ে গাছ পরিচর্যা, গাছে পানি দেওয়াসহ নানা কাজে লেগে পড়েন। পড়াশোনা শেষে তাঁর নিজেরও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ত্বিন চাষ করার ইচ্ছে আছে।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক দুলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ত্বিন একটি সম্ভাবনাময় ফসল। ত্বিন ফল চাষকে লাভজনক করতে পারলে বেকার তরুণদের কর্মসংস্থান হবে এবং অর্থনীতিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই ফল রপ্তানির মাধ্যমে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও সম্ভব। কৃষি বিভাগ প্রযুক্তিগত সহায়তাসহ নানাভাবে এই ফল চাষে চাষিদের সহায়তা প্রদান করছে।
বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল আলম বলেন, ত্বিন ফল অত্যন্ত পুষ্টিগুণে ভরা। এই ফল ক্যানসার প্রতিরোধ ছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি, কোষ্ঠকাঠিন্য ও হাঁপানি রোগ নিরাময় এবং মানসিক ক্লান্তি দূর করে। এতে আছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিংক, ম্যাগনেশিয়ামসহ নানা ভেষজ গুণ। এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস, হাড়ের রক্ষণাবেক্ষণ, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি, ত্বকের সৌন্দর্যবর্ধন এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।