ফেলনা কাঠ দিয়ে জীবনের বেলনা বেলছেন তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে। শুকনো কাঠে প্রাণ যুক্ত করে একা একাই দেখতেন। পরিচিতজন কাজ দেখেই বুঝেছেন—সমীরণ দত্ত আমাদের ‘ফাউন্ড অবজেক্ট’ শিল্পের পাল নতুন সমীরণে ভরে দেবেন। তবে হোক আয়োজন সবাই মিলে দেখার।
হ্যাঁ, সেই আয়োজন হয়েছে। তবে তা শহর বা উপশহরে নয়; নিভৃত গ্রামে। চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার ঘুঘুশাল গ্রামের সেই আয়োজন দ্রুতই নজর কেড়েছে সাধারণজনের। শিল্পের পসরা দেখতে প্রতিদিন দুই থেকে তিন শ দর্শনার্থী আসছেন সমীরণের ‘মনবাগানে’। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের আগ্রহই বেশি। ফেলে দেওয়া বিভিন্ন গাছের শিকড়-বাকড় বা গাছের অপ্রয়োজনীয় অংশ যে কীভাবে শিল্পে রূপ নেয়, তা তাদের মনে বিস্ময় জাগায়। চেনা কাঠের টুকরাটি কী জাদুটোনায় পাখির রূপ নেয়, গাছের পরিত্যক্ত শিকড় কীভাবে দারুণ প্রয়োজনীয় আর ব্যবহার্য হয়ে ওঠে—এসব তাদের অপার আনন্দ দেয়। কোনো শিল্পীর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রদর্শনী দেখার সুযোগ এদের বেশির ভাগেরই নেই বা হয়নি। সমীরণ দত্তের এই আয়োজন তাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে। এই প্রদর্শনীর কোনো দিনক্ষণ নেই। যে কেউ যখন-তখন এসে দেখতে পারেন তাঁর শিল্পকর্ম।
২০০৪ সালের দিকে ঢাকার কাছে গাজীপুরের পোড়াবাড়িতে কাজ শুরু করেন শিল্পী সমীরণ দত্ত। এই কাজের জন্য অনেক জায়গার প্রয়োজন। শহরে অত বড় জায়গা পাওয়া যেমন দুষ্কর, তেমন আর্থিক সংগতিও তাঁর নেই। ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে টিকতে পারলেন না গাজীপুরেও। বিড়ালছানার মতো সব মুখে করে স্থান বদলিয়ে চলে গেলেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। আর্থিক অনটনে সেখানেও বেশি দিন টিকতে পারেননি। সব নিয়ে ফিরে গেলেন নিজ গ্রামে, শিল্পের তাড়নায় একবার যে গ্রাম তিনি ছেড়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে ২০০৬ সালে ঢাকার গ্যালারি চিত্রকে হয় তাঁর প্রথম প্রদর্শনী। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে এ পর্যন্ত ১০ টির মতো প্রদর্শনী হয়েছে তাঁর শিল্পকর্মের।
শিল্পকর্মের বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই সমীরণ দত্তের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর ১৯৯৩ সালে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে হিসাবরক্ষকের চাকরি নেন। বছর দেড়েক পর স্বেচ্ছায় তা ছেড়ে দেন। ১৯৯৯ সালে এক বন্ধুর সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের অক্সিজেন এলাকার রৌফাবাদে ঘুরতে গিয়ে এক পুকুরের পাড়ে একটি গাছের শিকড় তাঁর নজর কাড়ে। তারপর তা তুলে এনে ছালবাকল উঠিয়ে একটা অবয়ব দেন। সমীরণ দত্ত বলেন, ‘তারপর সেটি নিয়ে যাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষক মনসুরুল করিম স্যারের কাছে। স্যার দেখে বললেন, “তুমি সমীরণ শেষ। এই শিল্পকর্মের ভেতরে যে ঢোকে, সে আর বেরোতে পারে না। তুমিও পারবে না। ”শেষ পর্যন্ত তাই হলো। প্রকৃতিতে যা–ই দেখি তাতেই কিছু না কিছু অবয়ব দেখতে পাই। আস্তে আস্তে পুরোপুরি এই শিল্পকর্মে লেগে পড়লাম।’
শিল্পী সমীরণ দত্ত বলেন, ‘২০০৩ সালের দিকে আমি কিছু শিল্পকর্ম বিষয়ে দেখা করি শিল্পী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গে। তিনিই তো এই শিল্পের পথিকৃৎ। যত দিন তিনি বেঁচে ছিলেন, তাঁর পরামর্শ ও সহযোগিতা আমি পেয়েছি।’
২০০৬ সালে রাজধানীর ধানমন্ডির গ্যালারি চিত্রকে তাঁর প্রদর্শনীতে প্রয়াত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ছিলেন প্রধান অতিথি, আর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আসেন বিশেষ অতিথি হয়ে। প্রথম দিনই ওই প্রদর্শনীকে নিজের উপস্থিতি দিয়ে আলোকিত করেছেন শিল্পী শিক্ষক সফিউদ্দিন আহমেদ।
এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার কাঠের শিল্পকর্ম ও আসবাব তৈরি করেছেন সমীরণ দত্ত। এর মধ্যে কিছু বিক্রি করেছেন, কিছু উপহার দিয়েছেন। কিছু কাজ প্রকৃতিতেই হারিয়ে গেছে রাখার জায়গা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। এখন তাঁর কাছে সংরক্ষিত আছে ছোট–বড় হাজারখানেক শিল্পকর্ম।
ঘুঘুশাল গ্রামকে যেন নতুন করে পরিচয় করাচ্ছেন অবনী মোহন দত্ত ও ছবি রানী দম্পতির ছোট ছেলে সমীরণ দত্ত। প্রথাগত স্টুডিওর বাইরে তাঁর উন্মুক্ত শিল্পশালা বা স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র মনবাগানে শিল্পকর্ম দেখতে প্রতিদিন ভিড় করছে মানুষ। তারা সেখানে ফেলনা কাঠের শিল্প হয়ে ওঠার পর্বও দেখতে পান। কারণ, দর্শনার্থীদের সামনেই চলে সব কাজ। ছোটখাটো শিল্পকর্ম, ব্যবহার্য নানা জিনিস কিনতেও পারেন দর্শনার্থীরা। ফলে এটা এখন একটা স্থায়ী গ্রামীণ মেলায় রূপ নিচ্ছে।
সম্প্রতি শিল্পী সমীরণ দত্তের মনবাগানে গিয়ে দেখা যায়, নিবিষ্ট মনে কাজ করছেন তিনি। আশপাশে কাঠের নানা ধরনের শিল্পকর্ম সাজানো। কোনো কোনোটা পড়ে আছে দৃশ্যত অযত্নে। বেশির ভাগই বিভিন্ন গাছের গোড়া বা শিকড়ের তৈরি। তাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিচ্ছবি। গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ব্যতিক্রমী খাট, সোফা, ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, টি টেবিল দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করছে। অখণ্ড মনোযোগে সে সব দেখছে তারা। অনেকে টুকটাক কিনেও নিচ্ছেন। জানা গেল, সর্বশেষ লিছুগাছের শিকড়ের তৈরি খাট বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৩ লাখ টাকায়। আছে ৫০ বা ১০০ টাকার সামগ্রীও।
নিজ গ্রামে ভাড়া করা প্রায় এক একর জমিতে মনবাগানের যাত্রা শুরু হয় চার মাস আগে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত তা সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রদর্শনীর পাশাপাশি আগ্রহী শিক্ষার্থীরা সেখানে শিল্পকর্ম নিয়ে হাতেকলমে জ্ঞানও নিতে পারছে।
শিল্পবোদ্ধাদের ভাষায়, এ ধরনের আয়োজন শিল্পপার্ক নামে পরিচিত। উন্নত বিশ্বের অনেক শহরে বা শহর–সংলগ্ন এলাকায় এমন পার্ক আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের আয়োজন খুব একটা চোখে পড়ে না। সমীরণের এই আয়োজন অনেকটা আধুনিক ধারার শিল্পপার্কের প্রতিরূপ।
মনবাগানে সমীরণের শিল্পকর্ম দেখতে চাঁদপুর ছাড়াও পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও নোয়াখালী এমনকি চট্টগ্রাম, ঢাকা থেকেও লোকজন আসছেন। কুমিল্লার বরুড়া থেকে পরিবার নিয়ে আসা ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বললেন, ‘দেশের অনেক জায়গায় অনেক কিছু দেখেছি। কিন্তু এই আয়োজন একদম ব্যতিক্রম। ফেলনা কাঠ বা গাছ দিয়ে শিল্পকর্ম এই প্রথম দেখলাম। বড় জায়গাজুড়ে ঘুরেফিরে দেখার পাশাপাশি এখানে মজার কফি, চটপটি, মাছের কাবাব, মাংসের পাকোড়া খেয়ে মনটা ভরে গেছে।’
চাঁদপুরের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মো. মইনুল হাসানও সম্প্রতি গিয়েছেন মনবাগানে। তিনি বলেন, ‘শিল্পী সমীরণ দত্তের যে শিল্পকর্ম, তা দেশে অনেকটা বিরল। খবর পেয়ে আমরা সেখানে গিয়েছি। তাঁর জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা আমাদের দিতে হবে। কারণ, প্রত্যন্ত এলাকায় এটা তরুণদের মনন গঠনেও ভূমিকা রাখবে।’
শিল্পী সমীরণ দত্ত বলেন, ‘এবার পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে আজ থেকে আট দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে মনবাগানে। ইচ্ছা আছে বাঙালির সব দেশজ উপলক্ষই আমরা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে আয়োজন করব। আর শিক্ষার্থীদের জন্য আমার কর্মশালা সারা বছরই চলবে।’
এই আয়োজন সম্পর্কে নিজের উচ্ছ্বাস জানিয়ে শিল্পী মনসুরুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমীরণের কাজ নিয়ে আমি আশাবাদীই ছিলাম। তাঁর এই প্রজেক্টটি আমি ফেসবুকে দেখেছি। তাতে আমার ধারণা হয়েছে, তিনি লোকজ পরিবেশে স্থানীয় উপাদান বাঁশ, শণ, কাঠ ইত্যাদি ফাউন্ড অবজেক্ট দিয়ে পরিবেশ তৈরি করে একটি শিল্পপার্ক করেছেন। সবটা মিলে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। যদি ধারাবাহিকতা রাখতে পারেন, তবে তাঁর দেখাদেখি এ ধরনের প্রচেষ্টা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে।’ তিনি বলেন, ‘যদিও বাংলাদেশের কয়েকজন আধুনিক ধারার শিল্পী নিজ এলাকায় এ ধরনের কাজ করেছেন, তবে সমীরণের এই উদ্যোগ অনন্য ও ব্যতিক্রম। তাঁর এই শিল্পপার্ক সারা দেশের মানুষ এমনকি বিদেশিদেরও আকৃষ্ট করবে বলে আমার বিশ্বাস।’