বরিশাল থেকে ঢাকা

ফেরি পারাপারে ‘দুর্বিষহ’ অপেক্ষার অবসান হচ্ছে আজ

ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় থাকা যানবাহনের দীর্ঘ সারি। শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় দৌলতদিয়া ফেরিঘাট সড়কে
ছবি: এম রাশেদুল হক

শুক্রবার সকাল থেকেই বরিশালে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। সকাল ১০টায় নগরের নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টির গতি বাড়ে। টার্মিনালে এসে ঢাকায় যাওয়ার বাসের টিকিট কাটতে গিয়ে বাধে বিপত্তি। শরীয়তপুরের জাজিরায় ফেরিপথ বন্ধ থাকায় এই পথের সব বাস বন্ধ। রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া–মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথ হয়ে অল্পসংখ্যক বাস চলছে। তবে টিকিট মিলছে না। কারণ, অনেক বাস পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভাড়া হয়ে গেছে। তাই যাত্রীরা হন্যে হয়ে বাস ধরার জন্য এ কাউন্টার ও কাউন্টার ঘুরছিলেন।

অনেক চেষ্টার পর সাড়ে ১১টার দিকে টিকিট পেয়ে লক্কড়ঝক্কড় মার্কা একটি বাসে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু হলো। দিনটা ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছে। শনিবার পদ্মা সেতুর দ্বার খুলবে। তাই আজ থেকে শিমুলিয়া-জাজিরা নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানে এ পথে ফেরি যুগের চির অবসান।

বাসে উঠে সিটে বসতে বসতে দেখা গেল, যাত্রীরা সবাই একে অপরের সঙ্গে আলাপে মত্ত। কান পেতে এই আলোচনার সারবস্তু পাওয়া গেল একটাই—পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। একজন বলছিলেন, ‌‘একটি সেতু নিয়ে গুগলে আড়াই কোটি সংবাদ হয়েছে—ভাবা যায়!’ আবার একজন যাত্রীর আক্ষেপ, ‘যদি সুযোগ থাকত, দুই দিন পরেই ঢাকায় যেতাম। পদ্মা সেতু দিয়ে কত্ত আরামে যেতে পারতাম, আহা!’

আরেক যাত্রী মাসুদ পারভেজ বলছিলেন, গত মাসে তিনি বরিশালে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। ফেরার সময় নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে সন্ধ্যা সাতটায় সাকুরা পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। তাঁদের বাস জাজিরায় ফেরিঘাটে গিয়ে পৌঁছায় রাত ১২টায়। অথচ ফেরিতে উঠতে পারেন ভোর চারটায়। দীর্ঘ চার ঘণ্টা বাসের মধ্যে বসে থাকতে হয় স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর অবসান হবে ফেরি পারাপারে দুর্ভোগের

শনিবার উন্মুক্ত হলেও ওই দিনই পদ্মা সেতু পার হওয়ার সুযোগ মিলছে না। সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হবে রোববার ভোরে। সেই দিনটার জন্য রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা দক্ষিণাঞ্চলের লাখো যাত্রীর।

ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন শাহ আলম। পারিবারিক কাজে তিন দিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী এসেছিলেন তিনি। শনিবার তাঁকে কাজে যোগ দিতে হবে। তাই আগেভাগে ঢাকায় ছুটছেন। ছুটির এক দিন হাতে রেখে ঢাকায় যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাসে করে ফেরি পার হয়ে ঢাকায় যেতে যে পরিমাণ ঝক্কি, তাতে এক দিন বিশ্রাম না নিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার অবস্থা থাকে না, খুব ক্লান্তি লাগে।’

এই প্রতিবেদকের পাশের আসনের যাত্রী গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইয়াসির আরাফাত। বারবার ঘড়ি দেখছিলেন তিনি। কারণ জানতে চাইলে ইয়াসির বলেন, ‘এখন বাজে তিনটা। কেবল ফরিদপুর এসেছি। দৌলতদিয়া ঘাটে পৌঁছাতে পৌনে ৪টা বেজে যাবে। ফেরি কখন পার হতে পারবে—নিশ্চয়তা নেই। ভাবছি, রাত ১০টায় ঢাকায় পৌঁছাতে পারবে কি না।’

আরাফাতের কথা শুনে মনে হলো, বরিশাল থেকে দৌলতদিয়া হয়ে ঢাকার দূরত্ব ২৭৭ কিলোমিটার। আর জাজিরা হয়ে এই দূরত্ব ১৮৮ কিলোমিটার। অর্থাৎ আমরা যে পথে ঢাকায় যাচ্ছি, এর দূরত্ব ৮৯ কিলোমিটার বেশি। এই ঘুরপথে ঢাকায় যেতে স্বাভাবিক অবস্থায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা লাগার কথা। কিন্তু আজ তো ঢাকায় লোকজন কম যাচ্ছেন, বাসগুলো বন্ধ। তাহলে এত সময় লাগবে কেন? নিজেই নিজেকে এই প্রশ্ন করছিলাম। এর মধ্যে ফরিদপুর ছাড়িয়ে রাহিদ্দা এলাকার একটি পেট্রোলপাম্পে যাত্রাবিরতি। আরাফাত ও আমি নামি। চা পান করতে করতে আরাফাতকে আবার জিজ্ঞেস করি, কেন এতে সময় লাগবে? আরাফাতের উত্তর, ‘গিয়েই টের পাবেন।’

আমাদের আলাপ শুনে চা–দোকানি মনিরুল স্বপ্রণোদিত হয়ে বলেন, ‌‘দৌলতদিয়া ঘাটে পাঁচ কিলোমিটার গাড়ির লাইন, যায়ে দেকভেন আনে।’ তাঁর কথায় মনটা দমে গেল। ফেরির প্রসঙ্গ ভুলে থাকতে খাবার হোটেলের মালিক মনিরুলের সঙ্গে আলাপ শুরু করি। পদ্মা সেতু চালু হলে ব্যবসায় তো মন্দা যাবে নাকি? এ প্রশ্নে মনিরুল বিষণ্ন মুখে বলেন, ‘করনের তো কিছু নাই। দক্ষিণবঙ্গের গাড়িগুলান আর এই পথের চলবে না। বেচাকিনি তো কমবেই।’

এই নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকলেও এখনো বিকল্প কিছু ভাবেননি মনিরুল। তাঁর সঙ্গে কথা শেষে বাসে উঠতেই আলাপ হলো চালক আবদুল হালিমের সঙ্গে। পদ্মা সেতু চালু হলে তাঁদের বাসগুলো এই পথে চলবে কি না, জানতে চাইলে আবদুল হালিম বলেন, ‘আমার বাড়ি ময়মনসিংহ। ইচ্ছা আছে ওই লাইনের গাড়িতে উঠমু। এই লাইন তো মন্দা অইবো।’

বিরতি শেষে সামনের দিকে এগোতে থাকে বাস। ঘড়ির কাঁটায় তখন পৌনে চারটা। বাস এসে দৌলতদিয়া ঘাটে থামে। আগেভাগে ঘাটে পৌঁছানোয় একটু স্বস্তি পেলাম। কিন্তু বাইরে নেমে সেই স্বস্তি হতাশায় পরিণত হলো। সামনে তখন কত বাস, তা গুনে শেষ করা যাবে না। ফেরি থেকে অন্তত তিন কিলোমিটার দূরে আছে আমাদের বাস। আরাফাতের মুখের দিকে তাকালাম। তাঁর মুখে রহস্যের হাসি। বুঝলাম এর মানে কী। ভোগান্তির শেষ কোথায় তা একরকম অনিশ্চিত।

ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছেন পণ্যবাহী গাড়িতে থাকা এক ব্যক্তি। শুক্রবার সন্ধ্যায় দৌলতদিয়া ফেরিঘাট সড়ক

শুরু হলো অপেক্ষার পালা। চারটা গড়িয়ে বিকেল পাঁচটা, সন্ধ্যা ছয়টা হয়ে সাতটা। অপেক্ষার পালা শেষ হয় না। সামনের গাড়িগুলো যেন অস্তাচলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর ক্লান্ত, বিরক্ত ও ক্ষুধার্ত যাত্রীরা একে একে ব্যাগপত্র নিয়ে হেঁটে ফেরির দিকে এগোতে থাকেন। নিজেকে একা মনে হলো। আরাফাত এবার বললেন, ‘কী আমাদের সঙ্গে যাবেন, নাকি আরও দুর্ভোগ পোহাবেন?’

আরাফাতের পিছু নিই। কিছুটা হেঁটে একটি রিকশা পেয়ে তাতে উঠে অবশেষে ফেরিতে পদ্মা পার হওয়ার দ্বিতীয় অভিযান শুরু হয়। পাটুরিয়া প্রান্তে পৌঁছাতে বাজে রাত পৌনে আটটা। এরপর রিকশা, আবার বাস—এভাবে বরিশাল থেকে রওনা দেওয়ার সোয়া ৯ ঘণ্টা পর রাত পৌনে নয়টায় ঢাকার গাবতলী বাস টার্মিনালে পৌঁছাই।

শেষবারের মতো ফেরি পার হয়ে ঢাকায় আসার যে ধকল গেল আজ, তা সারা জীবন মনে রাখবেন আমাদের বাসের যাত্রীরা। আমার নিশ্চয়ই এই স্মৃতি মনে পড়বে কখনো কখনো পদ্মা সেতু পার হতে হতে।