একসময় সড়কপথে ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায় যেতে ১০টি নদী ফেরিতে পাড়ি দিতে হতো। এখন দুবার ফেরিতে উঠতে হয়। একটি পদ্মায়, অন্যটি পায়রায়। পদ্মা সেতুর কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। পায়রা সেতুর কাজও ৯৯ শতাংশ শেষ। যেকোনো সময় যান চলাচলের জন্য খুলে যাবে সেতুটি।
এর মধ্য দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে আরেক ধাপ এগোবে দক্ষিণাঞ্চল। দূর হবে ফেরি পারাপারের ভোগান্তি। যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। আগামী অক্টোবর মাসেই সেতুটি উদ্বোধনের আশা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ঢাকা–কুয়াকাটা মহাসড়কের পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার লেবুখালী এলাকায় নির্মিত হয়েছে পায়রা সেতু। উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা সেতুটি ইতিমধ্যে দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর আলো ঝলমলে সেতুর দুই পাড়ে ভিড় জমায় বহু মানুষ।
২০১২ সালের মে মাসে সরকার পায়রা সেতু নির্মাণের প্রকল্পে অনুমোদন দেয়। শুরুতে সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪১৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পরে নকশা পরিবর্তন করে সেতুটি নির্মাণে চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা।
পায়রা সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, সেতুর ইতিমধ্যে ভায়াডাক্ট এবং মূল সেতুর সুপারস্ট্রাকচারের সব কটি স্প্যান সংযুক্ত হয়েছে। মূল সেতুর ২২৪টি আইগার্ডারে সব কটি নির্মাণ সম্পন্ন এবং ২৮টি ডেক স্ল্যাবের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দুই পাড়ের সংযোগ সড়ক, ওজন নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র স্থাপন এবং দক্ষিণ পাড়ে টোল প্লাজা ও প্রশাসনিক ভবনের নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। নদীশাসনের কাজও এগিয়ে চলছে।
পায়রা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হলে বরিশাল হয়ে পায়রা সমুদ্রবন্দর ও পর্যটন নগরী কুয়াকাটার জন্য সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত জাতীয় মহাসড়ক ফেরিমুক্ত সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে।
পায়রা সেতু প্রকল্প থেকে জানা যায়, এ সেতু নির্মাণের নকশা কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। চার লেনবিশিষ্ট সেতুটি নির্মিত হচ্ছে ‘এক্সট্রাডোজড কেব্ল স্টেইড’ প্রযুক্তিতে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর শাহ আমানত সেতুও এই প্রযুক্তিতে নির্মিত। ১ হাজার ৪৭০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার প্রস্থের সেতুটি কেব্ল দিয়ে দুই পাশে সংযুক্ত থাকবে। পানির উপরিভাগ থেকে সেতুটি নদীর ১৮ দশমিক ৩০ মিটার উঁচুতে। উভয় পাড়ে সাত কিলোমিটারজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে সংযোগ সড়ক। এই সেতুতে ১৩০ মিটার গভীরতম পাইল বসানো হয়েছে। নদীর মাঝখানে মাত্র একটি পিলার ব্যবহার করা হয়েছে। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক থাকবে।
দেশে প্রথমবারের মতো এই সেতুতে ‘ব্রিজ হেলথ মনিটর’ (সেতুর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ) স্থাপিত হচ্ছে। সেতুর পরিবেশগত ক্ষতি যেন না হয়, সেই লক্ষ্যেই এই প্রযুক্তি থাকবে। আলাদা সাব–স্টেশন থেকে সেতুতে বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে বাতি জ্বলবে। থাকছে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থাও।
২০ সেপ্টেম্বর বিকেলে সরেজমিন দেখা যায়, শেষ মুহূর্তে মূল সেতুতে কোনো ধরনের ত্রুটি রয়েছে কি না, তা পর্যবেক্ষণের কাজ চলছে। সেতুর সৌন্দর্যবর্ধনে ডিভাইডারে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো ও পরিচর্যা করা হচ্ছে। সন্ধ্যার পরপরই সেতুটি বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করে উঠেছে। আলোর রশ্মি পড়েছে পায়রা নদীতেও। সন্ধ্যার পরই দুমকি ও জেলা শহর থেকে লোকজন সেতুটি দেখার জন্য ভিড় করছেন। কেউ মুঠোফোনে সেতুর ছবি তুলছেন, অনেকে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেককে পরিবার–পরিজন নিয়ে সেতুর ফুটপাতে বসে সময় কাটাতে দেখা গেছে।
স্থানীয় রাসেল আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী রুবি আক্তার এসেছেন সেতু দেখতে। ঝলমলে আলোতে দুজন সেতুর ফুটপাতে বসেছিলেন। রাসেল বললেন, ‘এই সেতু এখন খুব সন্দর দেখাচ্ছে। এই এলাকায় ঘোরাফেরার জায়গা নেই। এই সেতুই এখন আমাদের কাছে দর্শনীয় স্থান।’
দুমকি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেলিম আকন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির এই পায়রা সেতু আজ দৃশ্যমান। স্বপ্নের পায়রা সেতু প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এই সেতু দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগে এক ধাপ এগিয়ে যাবে। কুয়াকাটা, মৎস্য বন্দর ও পায়রা বন্দরে যোগাযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে।
সেতুর প্রকল্প পরিচালক আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, মূল সেতুর কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। এখন শেষ পর্যায়ের ফিনিশিং চলছে। বর্ষা ও করোনার কারণে কাজ একটু পিছিয়ে পড়েছিল। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মাধ্যমে সেতুটি শিগগিরই যান চলাচলের জন্য খুলে যাবে।