নদ-নদীর পানি সামান্য কমেছে। রোদ আশা জাগাচ্ছে কৃষকের মনে। কিন্তু ঝুঁকিমুক্ত ভাবার কোনো কারণ নেই, বলছেন পাউবোর কর্মকর্তারা।
সুনামগঞ্জের হাওরপারের কৃষকের এখন ‘তীরে এসে তরি ডোবা’র দশা। একদিকে উজানের পাহাড়ি ঢলের ঝুঁকি, অন্যদিকে হাওরে পাকা–আধপাকা ধান। এই ধানের জন্যই ২০ দিন ধরে হাওরে বাঁধ রক্ষায় লড়াই করছেন তাঁরা। এখন ঝুঁকি আরও বেড়েছে। সপ্তাহখানেক সময় পেলে মোটামুটি সামলে নেওয়া যেত। কিন্তু এই সময়ের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউ।
তবে গতকাল মঙ্গলবার সুনামগঞ্জে প্রখর রোদ ছিল। সুরমাসহ অন্য নদ-নদীর পানি সামান্য কমেছে। রোদও আশা জাগাচ্ছে কৃষকের মনে। তবে ঝুঁকিমুক্ত ভাবার কোনো কারণ নেই, বলছেন প্রশাসন ও পাউবোর কর্মকর্তারা। এ অবস্থায় কৃষকেরা বাঁধের চেয়ে ধানেই মন দিয়েছেন বেশি। যে যেভাবে পারছেন ধান কাটছেন। কোথাও পাকা, আবার কোথাও ‘শেষ সম্বল’ হারানোর ভয়ে আধপাকা ধানই কাটছেন তাঁরা।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার নদ–নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় হাওরগুলোতে আবারও পানি ঢোকার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কৃষি বিভাগ বলছে, হাওরে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হয়েছে। গতকাল সকাল পর্যন্ত ৬২ হাজার ৩১৪ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। হাওরে শ্রমিকের সঙ্গে ৫২৫টি কম্বাইন হারভেস্টর মেশিন ও ১০৮টি রিপারে ধান কাটা চলছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ৫ মের মধ্যে হাওরের ভেতরের দিকের ধান কাটা শেষ হয়ে যাবে। বাকি থাকবে হাওরের বাইরের (উঁচু) জমির ধান।
প্রশাসন ও পাউবোর কর্মকর্তারা বলছেন, পানি যে পরিমাণ কমেছে, তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলার সুযোগ নেই। নদীতে কমলেও হাওরে পানির
চাপ আছে। উজানে বৃষ্টি হলে আবার পানি বাড়বে। ভারী না হলেও উজানে এবং সুনামগঞ্জে আগামী দুই দিন মাঝারি বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।
গতকাল দুপুরে জেলা শহর থেকে শান্তিগঞ্জ উপজেলায় যাওয়ার পথে দেখার হাওরের বিভিন্ন স্থানে কৃষকদের ধান কাটতে দেখা গেছে। রোদ থাকায় কাটা ধান খলায় আনার পর মাড়াই ও শুকানোর কাজ করছেন কৃষক পরিবারের নারী ও শিশুরা। দেখার হাওরের সদর উপজেলা অংশে আপাতত পানির ঝুঁকি নেই বলে ভাবছেন স্থানীয় কৃষকেরা। একই হাওরের শান্তিগঞ্জ উপজেলার মহাসিং নদের পশ্চিম পাড়ে গিয়ে দেখা গেল, ঢলের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে ধান। কেউ কোমরসমান পানিতে নেমে, কেউ নৌকায় করে আধপাকা ধান কাটছেন।
উপজেলার কুদিরাই গ্রামে বাড়ির উঠানে কথা হয় হাওর থেকে আসা কৃষক আনোয়ার হোসেনের (৪৫) সঙ্গে। উঠানে তখন মেশিন দিয়ে ধান মাড়াইয়ের কাজ চলছিল। আনোয়ার হোসেন সেই ধান দেখিয়ে বলেন, ধানগুলো আধপাকা, অর্ধেকও ঠিকবে না। তিন একর জমিতে আবাদ করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে এক একরের মতো ধান তিন শ্রমিককে নিয়ে টেনেটুনে তুলেছেন। পানি বাড়ছে, তাই বাকি জমির ধানের আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
তাঁর পাশে চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কৃষক আলাউদ্দিন (৭০)। তিনিও ধান কেটে এসেছেন। কথা বলে জানা গেল, আলাউদ্দিন ও আনোয়ার সম্পর্কে শ্বশুর ও জামাতা। জামাতা আনোয়ারের জমির ধান পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে, খবর পেয়ে সকালে কুদিরাই গ্রামে এসেছেন আলাউদ্দিন। তাঁর বাড়ি সদর উপজেলার জগজীবনপুর গ্রামে। ওই কৃষক জানান, দেখার হাওরে তাঁর ১১ একর জমি আছে। একদিকে ঢলের ঝুঁকি, অন্যদিকে জমির ধান এখনো পুরো পাকেনি। এখন ধান কাটবেন নাকি কয়েকটা দিনের ঝুঁকি নেবেন, তা–ই ভাবছেন। আলাউদ্দিন বলেন, ‘ধান কাটতাম, না কয়টা দিন দেখতাম, দোটানায় আছি। ভয় আছে, যদি বাঁধ ভাঙে, তাইলে কিন্তু সব শেষ।’
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানির উচ্চতা ছিল ৫ দশমিক ৯৪ মিটার। বেলা তিনটায় পানি ২ সেন্টিমিটার কমেছে। যেটি বিপৎসীমা থেকে ১৩ সেন্টিমিটার নিচে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে বৃষ্টি হয়েছে ২২ মিলিমিটার।
সুনামগঞ্জে এবার প্রথম দফায় পাহাড়ি ঢল নামতে শুরু করে গত ৩০ মার্চ। এতে জেলার নদ-নদী ও হাওরে প্রচুর পানি বাড়ে। ঝুঁকিতে পড়ে জেলার সব হাওরের বোরো ধান। একের পর এক হাওরের বাঁধ ভেঙে ও বাঁধ উপচে ঢলের পানি ঢুকে তলিয়ে যাচ্ছে হাওরের ফসল। ইতিমধ্যে জেলার ১৭টি ছোট–বড় হাওর ও বিলের ৫ হাজার ৬৬০ হেক্টর জমির ধান তলিয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। প্রথম দফা পাহাড়ি ঢলের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আবার দ্বিতীয় দফায় ঢল নামতে শুরু করে।
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলার ১৩৭টি ছোট–বড় হাওরে ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাওরের ভেতরে আছে ১ লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমি। এ পর্যন্ত হাওরের ৩৭ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। জেলা কৃষি বিভাগের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘হাওরে দ্রুত ধান কাটা হচ্ছে। আমরা সবাইকে ধান কাটায় উৎসাহ দিচ্ছি। বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকের ধান তোলায় সুবিধা হচ্ছে।’
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলোর দিকে আমাদের দৃষ্টি আছে। তবে গুরুত্ব দিচ্ছি ধান কাটায়। পাকা ধান জমিতে রাখা যাবে না। কখন কী হয়, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রতিটি বাঁধে ঝুঁকি আছে। তবে আশার কথা হলো, এখনো সুনামগঞ্জে বড় হাওরগুলোতে ধানের ক্ষতি হয়নি। কৃষকেরা ধান কাটছেন। তাঁরা ধান গোলায় না তোলা পর্যন্ত আমরা মাঠেই থাকব।’