রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় তৃতীয় ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। উপজেলার পাঁচটি ইউপির একটিতে মাত্র আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। তবে জাতীয় পার্টির দুর্গ বলে খ্যাত এ উপজেলায় জাপা কোনো জয়ের মুখ দেখেনি।
গত রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীদের বাইরে স্বতন্ত্র হিসেবে চারজন বিজয়ী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী দুজন, একজন জাসদ ও একজন স্বতন্ত্র।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অনেকে মনে করছেন, ইউনিয়ন পর্যায়ে যাঁরা ত্যাগী, জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য নেতা, দল তাঁদের মনোনয়ন না দিয়ে কম জনপ্রিয় নেতাদের মনোনয়ন দেয়। তাই প্রার্থী বাছাইয়ের ভুলেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ওই ভরাডুবি হয়েছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ভুলে পাঁচটির দুটি ইউপিতে নৌকার জয় হয়। এবারও একই ঘটনা।
প্রার্থী নির্বাচনের ভুলে মাত্র একটি ইউপিতে নৌকার জয় হয়েছে। তবে দুটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীর জয় হয়েছে। ইকরচালী ইউনিয়নে গত নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে দেড় শ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন ইদ্রিস উদ্দিন। এবার তিনি নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন চেয়ে না পাওয়ায় বিদ্রোহী হয়ে ওই ইউপিতে নির্বাচন করেন। নৌকা মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী আতিউর রহমানের চেয়ে বিদ্রোহী হয়ে তিন গুণ ভোট বেশি পেয়ে তিনি এবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এদিকে আলমপুর ইউনিয়নেও একই ঘটনা ঘটে। দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী স্বতন্ত্র হয়ে নৌকার প্রার্থী দেলওয়ার হোসেনের চেয়ে দ্বিগুণ ভোটে জয় লাভ করেছেন রবিউল ইসলাম।
শুধু কুর্শা ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকে জয়লাভ করেন আফজালুল হক সরকার। তিনি গত নির্বাচনেও নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নে গত নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেও এবার পরাজিত হয়েছেন হারুন অর রশিদ। এখানে জয়ী হয়েছেন জাসদের প্রার্থী কুমারেশ রায়। সয়ার ইউনিয়নে গত নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা নৌকা প্রার্থী জালাল উদ্দিন। এবার তিনি নৌকার মনোনয়ন না পাওয়ায় নির্বাচন করেননি। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে ভাতিজা গোলাম রব্বানী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন। ফলে এ ইউনিয়নেও নৌকা হেরে যায়।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাহারুল ইসলাম বলেন, প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এখানে নৌকার ভরাডুবি ঘটেছে। যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিলে অবশ্যই নৌকার জয় হতো। তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হেরে গেলেও দলের সাংগঠনিক অবস্থা এখানে ভলো।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জালাল উদ্দিন বলেন, জনপ্রিয়তা নেই এমন নেতা–কর্মীকে মনোনয়ন দেওয়ায় নৌকার ভরাডুবি হয়েছে। একই কথা বলেন সয়ার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল জলিল। উপজেলা আওয়ামী লীগের আরেক সহসভাপতি আনারুল ইসলাম বলেন, তারাগঞ্জে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের জন্য এখানকার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই দায়ী। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী নৌকার প্রার্থীর পক্ষে মাঠে কাজ করেননি।
রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রুহুল আমীন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তারাগঞ্জে ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এলাকায় জনপ্রিয়তা আছে, এমন ত্যাগী নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় তাঁদের জয় হয়েছে।
এদিকে কুর্শা, সয়ার, হাড়িয়ারকুঠি ও ইকরচালী ইউপিতে জাতীয় পার্টির সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন না। আলমপুর ইউনিয়নে জাতীয় পার্টির সমর্থিত প্রার্থী দেওয়া হলেও তিনি পরাজিত হন।
জাপার তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বলছেন, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড না থাকায় দল দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। জেলা, উপজেলা নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের যোগাযোগ নেই। এ কারণে চার ইউপিতে প্রার্থী হননি কেউ।
জাপার উপজেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আলী হায়াত খান বলেন, বাস্তবতা হলো তারাগঞ্জে জাপার দলীয় কোনো কার্যক্রম নেই। উপজেলা নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ইউনিয়ন নেতা-কর্মীদের নেই যোগাযোগ। সভা–সমাবেশও হয় না। দীর্ঘদিন থেকে গঠন করা হয়নি উপজেলা কমিটি। এক বছর আগে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে কোনো ভূমিকা রাখছেন না। এ কারণে ওই প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে।
তারাগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী জিকরুল হক বলেন, ইউপি নির্বাচনে দলীয় মার্কা দেখে ভোটাররা ভোট দেন না। প্রার্থীকে যাচাই-বাছাই করেই ভোটাররা ভোট দেন। আলমপুর ইউনিয়নে জাপা মনোনীত প্রার্থীর পরাজয় হলেও দলের সাংগঠনিক অবস্থা যে খারাপ, তা কিন্তু নয়।’