প্রাণ পাচ্ছে মৃতপ্রায় ধলেশ্বরী

ধলেশ্বরী নদীতে ড্রেজার দিয়ে চলছে খননকাজ। গত বুধবার দুপুরে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার অরঙ্গবাদ এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
ধলেশ্বরী নদীতে ড্রেজার দিয়ে চলছে খননকাজ। গত বুধবার দুপুরে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার অরঙ্গবাদ এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো

মানিকগঞ্জে মৃতপ্রায় ধলেশ্বরী নদী খননের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি ভুক্তভোগী এলাকাবাসী আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন। তাঁদের স্বপ্ন, ধলেশ্বরীতে পানির ঢল নামবে। বাড়বে ফসলের উৎপাদন। নিজ পেশায় ফিরে যাবেন জেলেরা। তাঁদের সেই স্বপ্ন ও দাবি বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। প্রাণ ফিরে পাচ্ছে মৃতপ্রায় ধলেশ্বরী।

১ নভেম্বর ধলেশ্বরী নদী খনন কার্যক্রম উদ্বোধন করেন স্থানীয় সাংসদ এবং স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

স্থানীয় লোকজন জানান, জেলার সাটুরিয়া, সদর ও সিঙ্গাইর—এই তিন উপজেলার ওপর দিয়ে ধলেশ্বরী প্রবাহিত। টাঙ্গাইলের উত্তর প্রান্তে যমুনা নদী থেকে এই নদীর উৎপত্তি। এরপর সাটুরিয়ার তিল্লী হয়ে এই নদী জেলা সদর ও সিঙ্গাইরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ঢাকার বুড়িগঙ্গায় মিলেছে। একসময় এই নদীকে ঘিরে এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার ঘটে। দুই পারের জমি ছিল উর্বর। ফসলের প্রচুর আবাদ হতো। নদীপারের মানুষ মাছ শিকার ও নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তবে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে মনুষ্যসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ভরাট হয়ে এই নদী স্বাভাবিকতা হারিয়েছে। ফলে এটি মরা খালে পরিণত হয়। নদীতে পানি না থাকায় কৃষি ও কৃষকের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই নদী খনন বাস্তবায়নের জন্য ‘ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটি’ গঠন করা হয়।

ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটির একাধিক সদস্য জানান, ২০১৩ সাল থেকে ধলেশ্বরী খননের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে ধলেশ্বরী নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটি। এতে নদীর তীরবর্তী লোকজনও যোগ দেন। ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জেলা সদরের জাগীর ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণে গণসমাবেশ, একই বছরের ২৯ অক্টোবর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মতবিনিময় সভা, ২০১৬ সালে ৩১ আগস্ট জেলা শহরে স্যাক কার্যালয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে মতবিনিময় সভা এবং জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দেওয়াসহ বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে ২৭ মার্চ বিশ্ব পানি দিবসের এক আলোচনা সভায় দেশের নদীকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, নদীর নাব্যতা বাড়ানো যায় এবং নদীর ধারণক্ষমতা বাড়ানো যায়—এসব বিষয় উঠে আসে। ওই সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পানিসম্পদমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট সচিব উপস্থিত ছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির কারণে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘বাংলাদেশ ব–দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ নামের একটি মহাপরিকল্পনা একনেকের সভায় অনুমোদন করা হয়। এই পরিকল্পনা থেকে ‘৬৪টি জেলার অভ্যন্তরের ছোট নদী, খাল এবং জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)’–এর আওতায় এই ধলেশ্বরী নদী পুনঃখননের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

পাউবো সূত্র আরও জানায়, ধলেশ্বরীর উৎসমুখ সাটুরিয়ার তিল্লী থেকে সিঙ্গাইরের ইসলামনগর পর্যন্ত ৪৫ দশমিক ৫০ কিলোমিটার নদী খনন করা হচ্ছে। পাঁচটি গুচ্ছে (প্যাকেজ) এই খনন কার্যক্রমে চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। নদীর তিল্লী এলাকা থেকে জান্না পর্যন্ত ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার, ফকুরহাটি থেকে জাগীর পর্যন্ত ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার, দশানী থেকে থেকে গুজুরী পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার, গুজুরী থেকে কাচারীকান্দি পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার এবং কাচারীকান্দি থেকে ইসলামনগর পর্যন্ত ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত—পাঁচটি গুচ্ছ নদী খনন করা হবে।

বুধবার থেকে সদর উপজেলার অরঙ্গবাদ এলাকায় ৪ নম্বর গুচ্ছে (গুজুরী থেকে কাচারীকান্দি) নদীর খননকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।

জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মাঈন উদ্দিন বলেন, খননকাজে আরও দুটি শক্তিশালী খননযন্ত্র ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া ধাপে ধাপে অন্যান্য স্থানেও খননকাজ শুরু করা হবে। আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। তবে এর আগেই আগামী জুন মাসের মধ্যেই খননের কাজ শেষ হবে।