এবার স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তেই ঝলমল করে জ্বলে উঠল আলো। আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৪ মিনিটে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্টে একসঙ্গে বাতি জ্বালানো হয়। এই প্রথম পুরো পদ্মা সেতু আলোকিত হলো, বাতি জ্বলল সব কটি ল্যাম্পপোস্টে। সেতু খুলে দেওয়ার ১১ দিন আগে ওই আলোর ঝলকানিতে উচ্ছ্বসিত পদ্মাপারের মানুষ।
সেতুর ঝলমল আলো দেখতে দুই প্রান্তেই লোকজন জড়ো হন। নিরাপত্তার কড়াকড়ির কারণে কেউ কাছে না যেতে পারলেও দূর থেকেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এমন মুহূর্ত স্মরণীয় করে রাখতে অনেকে ছবি তোলেন, অনেকে ভিডিও করেন। অনেকে প্রিয়জন ও বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে আলোকিত পদ্মা সেতু ফেসবুক লাইভে দেখান।
বিদ্যুতের দায়িত্বে থাকা সেতু বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ৪ জুন বিকেলে পদ্মা সেতুতে পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয়। ওই দিন সেতুর ১৪ থেকে ১৯ নম্বর পিলারের মাঝামাঝিতে ২৪টি ল্যাম্পপোস্টে বাতি জ্বালানো হয়েছিল। এরপর ১১ জুন পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে সেতুর সব কটি বাতি জ্বালানো হয়। তখন সেতুতে জেনারেটরের মাধ্যমে বাতি জ্বালানো হয়েছিল। গতকাল সোমবার মাওয়া প্রান্তে বৈদ্যুতিক সংযোগের মাধ্যমে ২০৭টি বাতি জ্বালানো হয়।
মঙ্গলবার মূল সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার ও দুই প্রান্তের ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার ভায়াডাক্টে একসঙ্গে আলো জ্বালানো হয়। পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আবদুল কাদের মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, মুন্সিগঞ্জ ও জাজিরা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দেওয়া বৈদ্যুতিক সংযোগের মাধ্যমে এই প্রথম সম্পূর্ণ সেতুর ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্টে পরীক্ষামূলকভাবে বাতি জ্বালানো হয়েছে। ৬টা ৫৪ মিনিটে ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার সেতুপথের দুই পাশের সব ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বালিয়ে দেন প্রকৌশলীরা। তিনি আরও বলেন, সেতুর ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে দিনে-রাতে যানবাহন চলাচলের জন্য সবটুকু কাজ শেষ হয়েছে।
৬টা ৫৪ মিনিটে ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার সেতুপথের দুই পাশের সব ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বালিয়ে দেন প্রকৌশলীরা।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সেতুর ভায়াডাক্টে প্রথম ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজ শুরু হয়েছিল। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতুতে মোট ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করা হয়। এর মধ্যে মূল সেতুতে ৩২৮টি, জাজিরা প্রান্তের ভায়াডাক্টে ৪৬টি, মাওয়া প্রান্তের ভায়াডাক্টে ৪১টি ল্যাম্পপোস্ট স্থাপন করা হয়। মূল সেতুতে ল্যাম্পপোস্ট বসানোর কাজ শেষ হয় ১৮ এপ্রিল। ২৪ মে পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের ৪২ নম্বর পিলারে সেতুর সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া হয়। শরীয়তপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে ৮০ কিলোওয়াট ও মুন্সিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে দেওয়া আরও ৮০ কিলোওয়াট বিদ্যুতে সেতুর ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্টে বাতি জ্বালানো হলো।
পদ্মাজুড়ে আলোর ঝলকানি দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন নৌপথে পারাপার হওয়া যাত্রীরা। জাজিরার মঙ্গল মাঝি-সাত্তার মাদবর ঘাট থেকে ফেরিতে চড়ে শিমুলিয়া যাচ্ছিলেন গোপালগঞ্জের মুকসেদপুরের বাসিন্দা ফারদিন ও নাতাশা দম্পতি। তাঁরা নৌপথ পাড়ি দিতে দিতে ফেরির দোতলায় দাঁড়িয়ে আলোকিত পদ্মা সেতু দেখে আনন্দে বিহ্বল হন। ফারদিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঢাকায় কাজ করি। এক আত্মীয়ের বিয়েতে গ্রামে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় ঢাকায় ফিরছিলাম। ফেরিতে উঠেই জানতে পারি, সেতুতে আলো জ্বালানো হবে। ফেরিতে চড়ে যেতে যেতে পুরো পদ্মা সেতুতে প্রথমবারের মতো জ্বলে ওঠা আলোকচ্ছটা দেখেছি। এটা আমাদের জীবনে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে।’
ঢাকা থেকে শিমুলিয়া ঘাট হয়ে লঞ্চে করে ফিরছিলেন শরীয়তপুরের গোসাইরহাটের বাসিন্দা লিয়াকত আলী। নদী পার হতে হতে তিনি পদ্মা সেতুর আলো জ্বালানোর দৃশ্য ফেসবুকে লাইভ করেন। লিয়াকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৪ সাল থেকে পদ্মা সেতুর নির্মাণযজ্ঞ দেখছি। ২০১৭ সালে যেদিন পদ্মার বুকে প্রথম স্প্যান বসানো হয়, সেদিনও আমি ঢাকা থেকে গ্রামে ফিরছিলাম। নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করছি। পদ্মা সেতুর দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে আমি পদ্মার বুকে ছিলাম। আর আমরা এমন একটি সেতু পেয়েছি, যা আমাদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আর ভাগ্যের দুয়ার খুলে দেবে।’
জাজিরার নাওডোবার বাসিন্দা হাকিম মাদবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৮ সালে যখন আমাদের জমি পদ্মা সেতুর জন্য অধিগ্রহণের নোটিশ করা হয়, সেদিন থেকেই স্বপ্নের সেতুর জন্য অপেক্ষা করছি। অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে। আজ নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আলোকিত পদ্মা সেতু দেখে গর্বে বুকটা ভরে গেছে।’
সর্বশেষ সন্ধ্যা ৭টা ৫৪ মিনিটে পদ্মা সেতুর সহকারী প্রকৌশলী মো. হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে কথা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তখনো সব কটি ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলছিল। তবে আজ রাতে কতক্ষণ সব ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলে থাকবে, সেটি সুনির্দিষ্ট করে তিনি বলতে পারেননি।
পদ্মা সেতুতে ৪১৫টি ল্যাম্পপোস্ট ছাড়াও আর্কিটেকচারাল লাইট জ্বালানো হবে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে, উৎসবের নকশা করে আর্কিটেকচারাল লাইট জ্বালানো হবে। পিলারের পানির অংশ থেকে রোডওয়ে স্ল্যাব পর্যন্ত সেতু ও ভায়াডাক্টে ওই লাইট অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে জ্বালানো হবে। সেতু চালু হওয়ার পর আর্কিটেকচারাল লাইটিংয়ের কাজ শেষ করা হবে।
২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন। ২৬ জুন সকাল থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগব্যবস্থার নতুন দ্বার উন্মোচিত হতে চলেছে।