সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যা

প্রত্যন্ত গ্রামে বন্যার্তরা ত্রাণ পাচ্ছে না

শহরে বন্যার্ত নিম্ন আয়ের মানুষ ত্রাণ পাওয়ার পাশাপাশি অন্য কিছুও করতে পারছে। কিন্তু গ্রামের মানুষ ত্রাণসহায়তা পাচ্ছে কম।

নিজের বাড়িতে বন্যার পানি ওঠায় পোষা ছাগল নিয়ে বাবার বাড়ির দিকে যাচ্ছেন সাজেদা বেগম। ডুবে যাওয়া সড়কপথে তীব্র স্রোত ভেঙে হাঁটছেন তিনি। গতকাল সকালে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার আমতলী এলাকায়
ছবি: আব্দুল আজিজ

সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যাকবলিত অনেক গ্রামে এখনো ত্রাণ পৌঁছায়নি। পানিতে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় গ্রামের অনেকের উপার্জন বন্ধ। যে খাবার মজুত ছিল, তা-ও শেষ। ফলে প্রত্যন্ত গ্রামের বানভাসি মানুষেরা খাদ্যসংকটে ভুগছে। অথচ সহজে যাওয়া যায়, বিশেষ করে শহরের অনেক এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা বেশি।

যেসব গ্রামে একেবারেই ত্রাণ যায়নি, এর একটি হচ্ছে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার বিশ্বনাথ ইউনিয়নের উত্তর ধর্মদা গ্রাম। গতকাল বুধবার দুপুরে গ্রামটিতে গিয়ে জানা গেছে, সেখানে অন্তত ১০০টি পরিবারে হাজারো মানুষের বসবাস। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক পরিবার দরিদ্র। এ গ্রামে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি আছে এখনো। অথচ এ গ্রামে সরকারি কোনো ত্রাণই পৌঁছায়নি বলে বন্যার্ত মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

উত্তর ধর্মদা গ্রামের কৃষক শেখ মকবুল আলী (৮০), শেখ সৈয়দ আলী (৬২), শেখ তোরণ মিয়া (৬০), শুকুর আলীসহ (৩৩) গ্রামের ১২ জনের সঙ্গে গতকাল কথা হয়। তাঁরা জানান, বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারি-বেসরকারি কোনো ত্রাণ তাঁরা পাননি।

উত্তর ধর্মদা গ্রামের মতো একইভাবে সরকারি কোনো ত্রাণ পৌঁছায়নি বিশ্বনাথের বাওনপুর, ইলিমপুর, রামপুর, সাতসেন ও তাজমহররমপুর গ্রামেও। সরেজমিনে এসব গ্রামে গেলে একাধিক বাসিন্দা জানান, গ্রামগুলোতে অনেক দরিদ্র পরিবারের বসতি। বন্যায় অনেকের বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। কাজ হারিয়ে অনেকে বেকার। ফলে দরিদ্র পরিবারগুলোতে খাদ্যসংকট চলছে।

উত্তর ধর্মদাসহ এসব গ্রামের অবস্থান বিশ্বনাথ ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। ইউপি সদস্য আবদুল মোমিন বলেন, ‘দুঃখ কইয়া লাভ নাই। কারে কইমু? যে অল্প পরিমাণ ত্রাণ আইছে, তা লইয়া গেলে মানুষে লাঠি দিয়া দৌড়াইব। মাত্র ২৫ প্যাকেট মুড়ি-চিড়া, আর তিন বস্তা চাল পাইছি। এই চাল সিরাজপুর গ্রামের ৬০টি পরিবারকে আড়াই কেজি করে দেওয়া হয়েছে। মুড়ি-চিড়ার প্যাকেটগুলো দেওয়া হয়েছে হিমিদপুর গ্রামে।’

স্থানীয় প্রশাসন বলছে, সিটি করপোরেশন ও জেলায় ৫৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ লাখ ২৭ হাজার ৬৫৩ জন আশ্রয় নিয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত বানভাসি মানুষের জন্য ১ হাজার ৩৯২ মেট্রিক টন চাল, ১৩ হাজার ২১৮ বস্তা শুকনো খাবার ও ২ কোটি ৭ লাখ টাকা নগদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ (গতকাল) আরও ৬০০ মেট্রিক টন চাল নতুনভাবে বরাদ্দ এসেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নতুনভাবে আরও ৬৫ লাখ টাকা সিলেটের জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন। তাই ত্রাণ নিয়ে জেলায় কোনো সংকট নেই। তবে গ্রামপর্যায়ে বানভাসি মানুষের কাছে যেন ত্রাণ পৌঁছায়, সেটি নিশ্চিত করতে জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

সিলেটের মতো সুনামগঞ্জ পৌর শহরেও সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ তৎপরতা বেশি। শহরের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো শুকনো ও রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। শহরে বন্যার্ত নিম্ন আয়ের মানুষ ত্রাণসহায়তা পাওয়ার পাশাপাশি অন্য কিছুও করতে পারছে। কিন্তু গ্রামের মানুষ ত্রাণসহায়তা পাচ্ছে কম। সরকারি উদ্যোগের বাইরে বেসরকারি উদ্যোগ তেমন চোখে পড়েনি।

বন্যার পানির স্রোতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সুনামগঞ্জের মণিপুরি হাটি গ্রামটি। অনেকের বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। গ্রামে এমন কোনো ঘর নেই, যেটি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। শুধু ঘরবাড়ি নয়। ভেঙে গেছে দোকানপাট, গাছপালা। বাড়িঘরের আঙিনা, সড়কে গর্ত হয়ে গেছে। ঢলের সঙ্গে নামা বালুর স্তূপ জমে আছে সবখানে। যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো গ্রাম। অসহায় মানুষগুলো তেমন কোনো ত্রাণসহায়তা এখনো পায়নি।

গতকাল দুপুরে সুনামগঞ্জ জেলা সদর থেকে নৌকায় বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের এই গ্রামে গিয়ে মানুষের খাবারের কষ্টের কথা জানা গেল। মণিপুরি হাটি গ্রামটি এলাকার চলতি নদের পশ্চিম পারে অবস্থিত। উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি এই গ্রামে ১৩০টির মতো ঘর আছে। এর মধ্যে ৩২টি পুরোপুরি বিধ্বস্ত। গ্রামের মানুষের বেশির ভাগই দরিদ্র, শ্রমিক।

গ্রামের বাসিন্দা বাছির মিয়া (৫৬) পুরো গ্রাম ঘুরে দেখালেন। এর সঙ্গে পুরোপুরি ভেঙে পড়া ৩২টি ঘরের মালিকদের একটি তালিকা ধরিয়ে দিলেন। গ্রামের মাঝামাঝি গিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া একটি ঘর দেখিয়ে আফসোস করে বললেন, ‘এই পরিবারটা বড়ই অসহায়।’ জানালেন, এটা শান্তনা বেগমের ঘর। তাঁর খোঁজ মিলল পাশের আমেনা বেগমের ঘরে। শান্তনা বেগম জানালেন, গ্রামের এর-ওর ঘরে এখন তাঁরা রাত কাটান। কেউ দিলে খান, না দিলে তিন ছেলেকে নিয়ে উপোস থাকেন। সকাল থেকে ছেলেরা কিছু খায়নি। আট বছরের তাসকিন মায়ের জামা ধরে ভাতের জন্য তখন কাঁদছিল। স্বামী আমির হোসেন সকাল থেকে খাবার আনবেন বলে বেরিয়েছেন। বেলা তখন তিনটা। স্বামী তখনো ফেরেননি।

মুঠোফোনে জানতে চাইলে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাদি উর রহিম জাদিদ জানান, এখন পর্যন্ত এই উপজেলায় তাঁরা ৩০ মেট্রিক টন চাল, এক হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং সাড়ে ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে মানুষের মধ্যে রান্না করা খাবার বিতরণ করেছেন। ত্রাণতৎপরতা অব্যাহত আছে।

ফেরার পথে উপজেলার ভাদেরটেক ও বালুচর গ্রামেও অনেক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত দেখা গেছে। এসব গ্রামের মানুষও বলেছেন, তাঁরা প্রয়োজনীয় ত্রাণসহায়তা পাচ্ছেন না।