নৃশংসভাবে খুন হলো বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। আবরারের মৃত্যু মানে এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই মৃত্যু, তাকে খুন করার মাধ্যমে এই পুরো বুয়েটকেই খুন করা হয়েছে। তবে তার এই খুনের বিষয়টি আসলে মনে হচ্ছে অবশ্যম্ভাবীই ছিল। আমরা গত বেশ কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহ যদি খেয়াল করি, তাহলে মনে হবে যে এ খুন হতে বেশ দেরিই হয়েছে। এর মধ্যে অনেক ঘটনা আমরা জানতে পারছি, যা আমরা আগে জানতাম না অথবা জেনেও না জানার ভান করতাম। আমরা কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র ও শিক্ষক; তাই বিষয়গুলোকে একটি অ্যালগরিদমের মতো করে সাজিয়ে লিখছি। ধরুন, হলের কোনো একজন ছাত্রকে অপর কোনো এক কালপ্রিট ছাত্র কোনো কারণে পেটানোর ইচ্ছা পোষণ করল। তাহলে নিচের ধাপগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে:
ধাপ-১: ওই ছাত্রকে কোনো একদিন রাতে হলের একটি বিশেষ কক্ষে (টর্চার সেল) ধরে নিয়ে আসতে হবে, যেখানে অত্যাচার করার সব সরঞ্জাম রয়েছে।
ধাপ-২: তারপর তাকে অত্যাচার করতে হবে।
ধাপ-৩: তবে অত্যাচার করার সময় বিশেষ করে খেয়াল রাখতে হবে, যাতে ছাত্রটি মরে না যায়।
ধাপ-৪: অত্যাচারপর্ব শেষ হলে, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে এবং অন্যান্য মাধ্যমে সব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে হবে যে ছেলেটি স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত/ শিবিরের সঙ্গে জড়িত কিংবা সমর্থক ছিল।
আমরা কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভাষায় যেকোনো অ্যালগরিদম ভালো না খারাপ, তা বোঝার জন্য প্রতিটি ধাপ বিশ্লেষণ করি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপটিকে চিহ্নিত করি। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধাপ হলো ধাপ-৩ ও ৪। এই দুটি যদি সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যায়, তাহলে এই অ্যালগরিদম ‘ফুলপ্রুফ’। আর এত দিন তা-ই হয়ে এসেছে। বুয়েটের অনেক ছাত্রকেই এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তা এখন পরিষ্কার। এর আগেও বিভিন্নভাবে আমাদের কানে এসেছে যে হলের ছাত্ররা বিভিন্নভাবে অত্যাচারিত হয়/হচ্ছে। কিন্তু ওই যে বললাম, ‘ফুলপ্রুফ’ অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সেই বিষয়গুলো ‘ম্যানেজ’ হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষ বলে, সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কথা বলেন কিংবা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কথাই বলেন, আমরা সবাই ‘ম্যানেজ’ হয়ে গেছি। ভেবেছি, এ আর এমনকি। কিন্তু এতেই সর্বনাশ হয়ে গেছে। আবরার ফাহাদ মরে গেছে; আর তাই আমরা এখন অনুধাবন করতে পারছি যে বুয়েটও আসলে পচে গেছে, মরে গেছে। আবরারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ‘ম্যানেজ’ হয়ে যাওয়ার পরিণতি! বিশ্ববিদ্যালয়ে আবরারের অভিভাবক হিসেবে তাকে নিরাপত্তা দিতে না পারায় আমরা আজ লজ্জিত! আজ তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের কাছে সমবেদনা প্রকাশ করার ভাষাও আমাদের নেই।
আমরা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন স্ট্যাটাস থেকে এমনও দেখতে পাচ্ছি যে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বা একাধিক ছাত্রেরও বুয়েটের হলে এসে এই রকম অত্যাচারের অভিজ্ঞতা হয়েছে! কী ভয়ংকর! আর আমাদের প্রশাসন এই বিষয়ে যে কোনো ভূমিকাই রাখেনি, তা তো বোঝাই যাচ্ছে; তারা গ্রহণ করেছে দেখেও না দেখার নীতি। দিনের পর দিন এই ধরনের অত্যাচার-অনাচার করে পার পেয়ে গেছে বলেই সেই কালপ্রিট, ছাত্র নামের কলঙ্কগুলো আরও সাহস পেয়েছে। বুয়েটের সাধারণ শিক্ষক হিসেবে এটি আমাদের জন্য ভীষণ লজ্জার।
ঘটনার পরম্পরায় এটি পরিষ্কার বোঝা গেছে যে এই খুনের সঙ্গে বুয়েট ছাত্রলীগের মূল কমিটির বিভিন্ন পদধারীরা সরাসরি জড়িত। এমনকি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির সরাসরি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমরা জেনেছি যে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ অতি দ্রুত একটা তদন্তের মাধ্যমে এর সঙ্গে জড়িত ১১ জনকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে। নিঃসন্দেহে এটি প্রশংসার দাবি রাখে। এর আগে এ ধরনের দ্রুত এবং স্থায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের মনে পড়ছে না। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। বুয়েটের এই কমিটি তো ছিল কেন্দ্রীয় কমিটিরই অনুমোদিত কমিটি। তাহলে কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে তাদের এই কমিটির পদ দেওয়া হয়েছিল? অত্যাচার করার সক্ষমতা? যে কেন্দ্রীয় কমিটি এই ধরনের নিয়োগ অনুমোদন করে, তাদের ওপর কি কোনো দায়িত্বই বর্তায় না? দল থেকে বহিষ্কার করলেও এই দায়িত্ব ছাত্রলীগ এড়াতে পারে না। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের এখন আসলে ভেবে দেখা দরকার, কেন ছাত্ররাজনীতি থেকে ভালো নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। ছাত্ররাজনীতিতে একজন মেধাবী ছাত্র যোগ দিয়ে একজন আদর্শবান যোগ্য নেতা না হয়ে কীভাবে এ রকম অমানুষ হয়ে উঠছে? আর তাই এহেন ঘটনার পর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ অথবা নিদেনপক্ষে স্থগিত করার প্রসঙ্গ এসেই যায়।
আমাদের মনে পড়ে, আশির দশকের শেষ দিকে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা চলত। তখন এত চ্যানেল কিংবা এত পত্রিকাও ছিল না। তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকাটি খুবই জনপ্রিয় ছিল। আর সেখানে খুব সাহসী প্রতিবেদন ছাপা হতো। এসব প্রতিবেদনে তখন ফুটে উঠত শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের কথা আর তার মূল অনুষঙ্গ হিসেবে শিবিরের পায়ের রগ কাটার রাজনীতির কথা। ঘটনার পরম্পরায় আজ বুয়েট, তথা শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের মূল নায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্রলীগ/যুবলীগের নানা পদধারী ছাত্র/ব্যক্তিরা আর রগ কাটার জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে স্টাম্প, লাঠি, রড, চাপাতি এগুলো (বিশ্বজিতের কথা স্মরণ করুন!)। যে দল আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, যে দল আমাদের দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর দল, সেই দলের অধীন ছাত্রসংগঠনের পদধারী ছাত্ররা সন্ত্রাস-দুর্নীতি করে বেড়াবে? ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু তনয়ার এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ আমরা দেখতে পেয়েছি। আর তার কিছু ফলও আমরা পাচ্ছি। কিন্তু আরও কঠিন পদক্ষেপ দরকার।
ছোটবেলায় ভাবসম্প্রসারণ করতাম—‘অসির চেয়ে মসি বড়’। বড় বড় কথা লিখতাম—‘শাশ্বত ন্যায়যুদ্ধে মসিই প্রকৃত বিজয়ী হবে। তাই মসিই হওয়া উচিত আমাদের জীবনে চলার পথের পাথেয়’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, এখন মনে হয়, যা আগে ভেবেছি ও জেনেছি, ভুল জেনেছি; স্টাম্প আর রডই তো বড়; চাপাতি তো আরও বিশাল! কলমের শক্তি আর কোথায়? তাই বলছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গবেষণার চিন্তা করার কোনো দরকার নেই। নাকি সব হতাশা ঝেড়ে ফেলে আমরা আরেকটা চেষ্টা করে দেখব? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটা শুদ্ধি অভিযান তো শুরু করেছেন। আমরাও যে যার জায়গা থেকে শুদ্ধি অভিযানটা চালাই? প্রমাণ করার চেষ্টা করি যে অসির শক্তি আসলেই ক্ষণস্থায়ী।
মাহমুদা নাজনীন, আতিফ হাসান রহমান, রিফাত শাহরিয়ার, মাহমুদুর রহমান, মাহজাবিন নাহার, নাফিস ইরতিজা, প্রীতম সাহা, টি এম তারিক আদনান, মো. সাইফুল ইসলাম, সাদিয়া শারমিন, মো. সামসুজ্জোহা বায়েজীদ, মো. আশিকুর রহমান, মুহাম্মদ আলী, মো. তরিকুল ইসলাম, মো. সোহরাব হোসেন, শরীফ আহমেদ, অনিন্দ্য ইকবাল, চৌধুরী মো. রাকিন হায়দার, শাদমান সাকিব ইউসুফ, মো. সাইফুর রহমান, আবদুস সালাম আজাদ, সাক্ষর চক্রবর্তী, এ বি এম আলিম আল ইসলাম, ইশতিয়াক আহমাদ, মোহাম্মদ ইউনুস আলী, তানজিমা হাশেম, মো. ইফতেখারুল ইসলাম, মো. সাইদুর রহমান, মো. সোহেল রহমান ও মো. কায়কোবাদ। লেখকেরা বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের (সিএসই) শিক্ষক।