যানজট, জলাবদ্ধতা, বেহাল সড়কে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। সিটি করপোরেশন গঠনের আড়াই বছরেও বাড়েনি নাগরিক সুবিধা।
বিলুপ্ত ময়মনসিংহ পৌরসভার প্রধান নাগরিক সমস্যা ছিল যানজট, জলাবদ্ধতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। সঙ্গে ছিল ফুটপাত দখল ও ভাঙাচোরা সড়কের যন্ত্রণা। ২০১৯ সালের মে মাসে সিটি করপোরেশন হওয়ার পর মানুষের আশা ছিল এসব সমস্যা কমে আসবে। বাড়বে নাগরিক সুবিধা। কিন্তু এখনো পুরোনো সব সমস্যার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছেন ময়মনসিংহ নগরবাসী।
ময়মনসিংহ পৌরসভার ২৫টি ওয়ার্ডের সঙ্গে শহরতলির আরও কিছু এলাকা সংযুক্ত করে ৩৩টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত হয় সিটি করপোরেশন। নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলোতে আড়াই বছরের বেশি সময়ে দৃশ্যমান কোনো নাগরিক সুবিধা বাড়েনি। ৩১ নম্বর ওয়ার্ডটি মূল শহর থেকে বিচ্ছিন্ন; ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে। এই ওয়ার্ডের বাসিন্দারা এখনো নৌকায় করে নদ পার হন। আগের সেই ভাঙাচোরা আর বালুর স্তূপের সড়ক দিয়ে চলাচল করছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সভাপতি শিব্বির আহমেদ বলেন, ময়মনসিংহের প্রধান নাগরিক ভোগান্তি হলো যানজট। কিন্তু এ ভোগান্তি নিরসনে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক আর রিকশা দিন দিন আরও অনিয়ত্রিত হয়ে পড়েছে। জলাবদ্ধতা সংকটও নিরসন হচ্ছে না। নগরের নর্দমাগুলোকে নদমুখী করে ব্রহ্মপুত্রের দূষণ নতুন ভোগান্তির সৃষ্টি করছে।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে নগরে নিবন্ধিত ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের সংখ্যা সাত হাজার। এ ছাড়া মোটা চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে ছয় হাজার এবং চিকন চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে ৫ হাজার ৫০০। পায়ে চালিত রিকশার সংখ্যা ৫০০। এসব ইজিবাইক আর রিকশা দুই ভাগে ভাগ হয়ে প্রতিদিন অর্ধেক সংখ্যক চলাচল করে। তবে নাগরিকদের অভিযোগ, প্রকৃতপক্ষে নগরে ইজিবাইক ও রিকশার সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কোনো নিয়ম না মেনেই এসব যান নগরের রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যে কারণে দিনে দিনে যানজট বেড়েই চলছে। বিভিন্ন সভা–সেমিনারে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ প্রশাসন নাগরিক সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করে সমাধানের উপায় খোঁজার কথাও বলেন। কিন্তু তাতে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
নগরের বাসিন্দারা বলছেন, ছোট শহরের সরু সড়কের তুলনায় ইজিবাইক আর রিকশার সংখ্যা বেশি। ফলে নগরের সব কটি সড়কে সারা দিন অসহনীয় যানজট থাকে। বিশেষ করে নগরের ব্যস্ততম গাঙ্গিনারপাড়, নতুন বাজার এবং চরপাড়া এলাকায় যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। এ ছাড়া নগরের ভেতর দিয়ে যাওয়ায় ১০টি রেলক্রসিংয়ের কারণেও সৃষ্টি হয় যানজট।
সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. ইকরামুল হক বলেন, যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য তাঁরা একাধিক বাস টার্মিনাল নগরের বাইরে স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ ছাড়া অবৈধ যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্যও বিআরটিএ এবং পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে সিটি করপোরেশন কাজ করবে।
নগরের বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃষ্টি হলেই গাঙ্গিনারপাড়, নতুন বাজারের প্রধান সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। চরপাড়া এলাকার প্রধান সড়কে পানি না জমলেও পাড়া–মহল্লার প্রায় সব সড়কে পানি জমে। এ ছাড়া নগরের আকুয়া, সানকিপাড়া, সি কে ঘোষ, নওমহল, লিচুবাগান, ডিবি রোড, নয়পাড়াসহ আরও অনেক সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। নাগরিকদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশন হওয়ার পর জলাবদ্ধতা একটুও কমেনি। বরং কিছু এলাকায় এ সমস্যা আরও বেড়েছে।
আকুয়া এলাকার বাসিন্দা মো. শাহজাদা বলেন, গত তিন থেকে চার বছরে আকুয়ার জলাবদ্ধতা আরও বেড়েছে। এক ঘণ্টা ভারী বৃষ্টি হলে পরের কয়েক ঘণ্টা ঘর থেকে বের হওয়া যায় না।
যদিও সিটি করপোরেশন বলছে, নগরের ভেতর দিয়ে যাওয়া সেহরা খাল, মাকরজানি, গোয়াইলকান্দি খাল ও বগামারি খাল ভরাটের কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো। সিটি করপোরেশন হওয়ার পর একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ওই সব খালের আবর্জনা অপসারণ করা হয়। তবে জলাবদ্ধতা কমেনি।
যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে ময়মনসিংহ শহরের পরিবেশ নোংরা থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সিটি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে আবর্জনা ব্যবস্থাপনাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন ইকরামুল হক। সেই চ্যালেঞ্জ সামলাতে গত আগস্টে নগরের ৫০টি স্থানে সিটি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ওই সব ক্যামেরায় যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা কোনো ব্যক্তি ধরা পড়লে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। এ পর্যন্ত নিয়ম ভেঙে আবর্জনা ফেলার কারণে কমপক্ষে ১০০ জনকে জরিমানা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
এতে নগরের আবর্জনা ব্যবস্থায় কিছুটা শৃঙ্খলা এলেও এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা। বর্তমানে দিনের বেলা আবর্জনা দেখা না গেলেও বিকেলের দিকে আকুয়া এলাকা ডিবি রোড, সানকিপাড়া চরপাড়া ও নয়াপাড়া এলাকায় আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা যায় বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ।
নগরের বিভিন্ন এলাকায় সিটি করপোরেশন ও সওজের কিছু সড়ক বেহাল অবস্থায় রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, নবগঠিত ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের জুবলি কোয়ার্টার, মোড়লপাড়া হয়ে মাসকান্দা সড়ক, চরপাড়া মোড় এলাকা বেহাল। এ ছাড়া পাটগুদাম এলাকা থেকে শম্ভুগঞ্জ পর্যন্ত পুরো সড়ক এবং কেওয়াটখালী বাইপাস সড়ক বেহাল। ওই সড়কগুলোতে ঝুঁকি নিয়ে চলে যানবাহন।
ময়মনসিংহ পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার সময় নতুন সংযুক্ত আটটি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩১ নম্বর ওয়ার্ডটি ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে। খেয়াঘাট দিয়ে নৌকায় ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে যেতে হয় ওই ওয়ার্ডের নাগরিকদের। সিটি করপোরেশন হওয়ার আড়াই বছরের বেশি সময় পরও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের জন্য যোগ হয়নি ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা। ব্রহ্মপুত্র পার হতেই আগের মতো সেই বালুর স্তূপ হেঁটে পার হয়ে সড়কে উঠতে হয়। সড়কটির অবস্থাও বেহাল।
ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দা ময়মনসিংহ মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ সৈয়দ মোশাররফ হোসেন বলেন, সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর বাস্তবিক অর্থে এ ওয়ার্ডের কোনো উন্নয়ন হয়নি।
সিটি মেয়র ইকরামুল হক বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘ সময় তাঁরা কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নকাজ করতে পারেননি। করোনা নিয়ন্ত্রণে আসায় এখন দ্রুত উন্নয়নকাজ করতে চান। ৩১ নম্বর ওয়ার্ডেও ১৫ কোটি টাকার প্যাকেজে বিভিন্ন উন্নয়নকাজ শুরু হবে।