হবিগঞ্জের অনন্তপুর এলাকায় পুরাতন খোয়াই নদ দখলদারদের তালিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সম্পৃক্ত রয়েছেন। এমনকি দখল করা স্থানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে।
হবিগঞ্জের অনন্তপুর এলাকায় পুরাতন খোয়াই নদের জায়গা দখল করে পৌর কৃষক লীগের কার্যালয়ের জন্য পাকা ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। গত বছরের মার্চ মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কয়েক দফায় জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে নদের জমিতে অবৈধভাবে থাকা অন্য আরও স্থাপনার সঙ্গে এখানে থাকা ঘরটিও উচ্ছেদ করেছিল। প্রায় এক বছরের ব্যবধানে উচ্ছেদ করা সেই জমিতেই কৃষক লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ের ব্যানার সাঁটিয়ে সেখানে এখন ঘর নির্মাণ চলছে।
গত সোমবার বিকেলে কয়েকজন শ্রমিককে এ ঘর তৈরিতে কাজ করতে দেখা গেছে। এ ঘর নির্মাণে জেলা কৃষক লীগের যুগ্ম সম্পাদক এস এ মাহফুজ জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে মাহফুজ ছাড়াও অন্তত দুই হাজার ব্যক্তি গত চার দশকের ব্যবধানে পুরাতন খোয়াই নদের পাঁচ কিলোমিটার জায়গা দখল করে স্থায়ী স্থাপনাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নদ দখলদারদের তালিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সম্পৃক্ত রয়েছেন। এমনকি দখল করা স্থানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। নদের জায়গা দখলে অভিযুক্ত এস এ মাহফুজ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, এখানে তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি রয়েছে। তবে নিজেদের জায়গার পাশে পৌর কৃষক লীগের যে কার্যালয় নির্মাণ করার প্রক্রিয়া নেওয়া হয়েছিল, সে কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে।
মাহফুজ আরও বলেন, ‘আমাকে পৌর কমিটি গোছানোর জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এখানে (স্থাপনা তৈরির স্থান) তাঁরা (পৌর কমিটি) বসেন। তবে এখন কাজ বন্ধ রয়েছে। এটা অস্থায়ী কার্যালয়, ভবিষ্যতে যদি প্রশাসন নিয়ে যায়, তাহলে নিয়ে গেল। স্থায়ী কিছু এখানে করা হচ্ছে না।’ মাহফুজ এ সময় স্বীকার করেন, গত বছর এ জায়গা থেকে স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল।
জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), পরিবেশকর্মীসহ বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালের জুলাই মাসে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসন নদের দখলদারের একটি তালিকা তৈরি করে ঢাকার জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কাছে পাঠিয়েছে। যদিও সে তালিকা পূর্ণাঙ্গ নয় বলে স্থানীয় পরিবেশকর্মীরা জানিয়েছেন। পরিবেশবাদীদের হিসাবে নদের জায়গা দখল করে দুই হাজারের বেশি স্থাপনা তৈরি হয়েছে। এর বিপরীতে জেলা প্রশাসনের তালিকায় মাত্র ৮৩ জন দখলদারের নাম-পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের তালিকায় দখলদার হিসেবে বিএনপির সাবেক পৌর মেয়র জি কে গউসের নামও এসেছে।
জি কে গউস বলেন, ‘নদী, খাল কিংবা কোনো কিছু দখলের সঙ্গে আমার মিনিমাম সম্পর্ক নেই। এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক চক্রান্ত। আমার ৫৩ বছর বয়সের মধ্যে রাষ্ট্রের কাছে কোনো ভূমির জন্য আবেদন করিনি কিংবা দখল করিনি। কেউ এটা প্রমাণ করতে পারলে আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমার অংশগ্রহণের পর আমাকে একে একে রাজনৈতিকভাবে হেনস্তা করতে ইচ্ছা করেই আমার নাম জড়ানো হচ্ছে।’
তালিকা তৈরির আগে ও পরে জেলা প্রশাসন এবং পাউবো নদের সীমানা নির্ধারণের পাশাপাশি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদকাজ শুরু করে। এ সময় অভিযান চালিয়ে কয়েক শ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। তখন তালিকায় থাকা ৮৩ দখলদার ছাড়াও নদের সীমানার মধ্যে থাকা স্থাপনা চিহ্নিত করে লাল ক্রস চিহ্ন আঁকা হয়। এ রকম একটি চিহ্ন রয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি এবং হবিগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. সিরাজুল হক চৌধুরীর বাসায়ও।
সিরাজুল হক চৌধুরী বলেন, ‘১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা একসনা বন্দোবস্ত নিয়ে আমরা এখানে আছি। অথচ বহুতল ভবন করে অনেকেই আছেন, সেটা উচ্ছেদে কেউ হাত দেয় না। ১৯৯০ সালের দিকে আমরা ১১০ জন মুক্তিযোদ্ধা মৎস্যজীবী হিসেবে জায়গা বন্দোবস্ত নিয়েছিলাম। এরপর সেখানে মুক্তিযোদ্ধা আবাসন প্রকল্প তৈরির অনুমোদন নিই।’
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রায় দুই হাজার ব্যক্তি পুরাতন খোয়াই নদের জায়গা দখল করে বাসাবাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের কাঁচা-পাকা স্থাপনা তৈরি করেছেন। কেউ কেউ বনায়নও করেছেন। ব্যক্তি ছাড়াও হবিগঞ্জ জেলা পরিষদ, ডায়াবেটিক হাসপাতাল, হবিগঞ্জ প্রতিবন্ধী স্কুল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, জেলা ও শহর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, গ্রন্থাগারসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নদের জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে। বেদখল হওয়া পুরো জায়গা উদ্ধার না করেই গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে নদে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান থেমে যায়। এরপর এখন পর্যন্ত আর কোনো অভিযান চালায়নি স্থানীয় প্রশাসন।
বেদখল হওয়া পুরো জায়গা উদ্ধার না করেই গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে নদে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান থেমে যায়। এরপর এখন পর্যন্ত আর কোনো অভিযান চালায়নি স্থানীয় প্রশাসন।
নদটি শহরের অন্যতম জলাধার ছিল। অথচ এটি দখল হয়ে এখন প্রায় পুরোটাই অস্তিত্বহীন নদে পরিণত হয়েছে। নদের আগের রূপ ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় প্রশাসনকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে।তোফাজ্জল সোহেল, সাধারণ সম্পাদক, বাপা, হবিগঞ্জ
পুরাতন খোয়াই নদের শুরুর জায়গায় ছয়তলাবিশিষ্ট ডায়াবেটিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি শহীদ উদ্দিন চৌধুরী নদের জায়গায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ২০ বছর আগে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি জানিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি তো লাভজনক প্রতিষ্ঠান নয়, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। জনগণের পয়সায় তৈরি করা হয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ জায়গা ডায়াবেটিক হাসপাতালের নামে দলিল করে দিয়েছেন।’
সচেতন বাসিন্দা ও পরিবেশ সংগঠকেরা জানিয়েছেন, চার দশক আগে হবিগঞ্জ শহরের ওপর দিয়ে খোয়াই নদ প্রবাহিত হওয়ায় প্রায়ই বন্যা হতো। শহর রক্ষার জন্য এ সময় মাছুলিয়া থেকে রামপুর এবং খোয়াই মুখ থেকে গরুর বাজার পর্যন্ত নদের পাঁচ কিলোমিটারে দুই দফা লুপ কাটিংয়ের (আঁকাবাঁকা সোজাকরণ) মাধ্যমে গতিপথ পরিবর্তন করে শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত করে দেওয়া হয়। এর ফলে শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খরস্রোতা খোয়াই নদ শান্ত হয় এবং লুপ কাটিংয়ের ফলে পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদটি মূল নদের মর্যাদা পায়। এর ফলে আগের নদটি পুরাতন খোয়াই নদ হিসেবে পরিচিতি পায়।
একই সূত্রের তথ্যানুযায়ী গতিপথ পরিবর্তনের চার দশকের ব্যবধানে ধীরে ধীরে পুরাতন খোয়াই নদের অন্তত চার কিলোমিটার অংশ বেদখল হয়ে নদ তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। বাকি এক কিলোমিটার অংশের কোথাও পানি রয়েছে, কোথাও ঝোপঝাড় তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল জানান, নদটি শহরের অন্যতম জলাধার ছিল। অথচ এটি দখল হয়ে এখন প্রায় পুরোটাই অস্তিত্বহীন নদে পরিণত হয়েছে। নদের আগের রূপ ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় প্রশাসনকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে।
পরিবেশ সংগঠকেরা জানিয়েছেন, গতিপথ পরিবর্তনের আগে পুরাতন খোয়াই নদের প্রস্থ ছিল স্থানভেদে ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট এবং গভীরতা ছিল ২৫ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত। বর্তমানে নদের জায়গার প্রায় পুরোটাই বেদখল হয়ে গেছে। যতটুকু দখলের হাত থেকে এখনো রক্ষা পেয়েছে, সেখানে প্রস্থ ২০ থেকে ১৫০ ফুট রয়েছে। নদের জায়গায় এত বেশি স্থাপনা হয়েছে, দেখে মনে হবে এখানে কোনো নদের অস্তিত্বই ছিল না। জলাবদ্ধতা নিরসনসহ শহরের সৌন্দর্যের স্বার্থে নদ খনন ও সংরক্ষণ প্রয়োজন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) হবিগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহানেওয়াজ তালুকদার জানান, পুরাতন খোয়াই নদের সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যের জন্য ৮৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হলে সে কাজ সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের শ্যামলী, পুরান মুন্সেফি, মুসলিম কোয়ার্টার, হরিপুর, নাতিরাবাদ, বগলাবাজার, মাছবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় পুরাতন খোয়াই নদ দখল করে অসংখ্য স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তারেক মোহাম্মদ জাকারিয়া প্রথম আলোকে জানান, যে তালিকা নদী কমিশনে পাঠানো হয়েছে, সেটা পূর্ণাঙ্গ ছিল না। এখানে কিছু দখলদারের নাম রয়েছে। এর বাইরেও দখলদার রয়েছেন। তালিকা প্রকাশ পেলেই দখলদারেরা উচ্চ আদালতে গিয়ে স্থাপনা উচ্ছেদ না করতে স্থগিতাদেশ আনার চেষ্টা করেন। তাই কৌশলের অংশ হিসেবে সব দখলদারের নাম তখন প্রকাশ করা হয়নি। তবে এখানে দুই হাজারের বেশি অবৈধ দখলদার ছিলেন বা আছেন বলে তিনি স্বীকার করেছেন।
তারেক মোহাম্মদ জাকারিয়া আরও বলেন, বেশির ভাগ অবৈধ স্থাপনা এরই মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাকি অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে পুনরায় অভিযান শুরু হবে। আর নদের সীমানা পুরোটাই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মেপে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিছু স্থাপনা উচ্ছেদে আদালতের নিষেধাজ্ঞা বা স্থগিতাদেশ রয়েছে। আবার নদের কিছু জায়গা অতীতে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে এবং মামলাসংক্রান্ত জটিলতা রয়েছে। সেসব স্থাপনায় লাল ক্রস চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়েছে।