তিন বছর আগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মুক্তামণির দুই হাত মারাত্মকভাবে পুড়ে যায়। ক্ষত ছড়িয়ে পড়ে দুই হাতে। বাধ্য হয়ে তার কনুই থেকে দুই হাত কেটে ফেলেন চিকিৎসকেরা। তবু দমে যায়নি মুক্তামণি। পা দিয়ে লিখে সে এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় (পিইসি) জিপিএ-৫ পেয়েছে।
মুক্তামণি বরিশালের হিজলা উপজেলার সেন্টু সরদার ও ঝুমুর বেগম দম্পতির মেয়ে। দুই বোনের মধ্যে সে বড়। উপজেলার পূর্ব পত্তণীভাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সে পিইসি পরীক্ষা দিয়েছিল।
সেন্টু সরদার সপরিবার গাজীপুরে থাকতেন। তিনি বাসচালকের সহকারীর কাজ করতেন। স্ত্রী ঝুমুর বেগম ছিলেন গৃহিণী। ২০১৫ সালে সেন্টু সরদার বাসের নিচে চাপা পড়ে গুরুতর আহত হন। প্রাণে বাঁচলেও তিনি একটি পা হারিয়ে পঙ্গু হয়ে যান। তাঁর চিকিৎসার জন্য গ্রামের জমিজমা বিক্রি করতে হয়। তখন পরিবারের হাল ধরেন ঝুমুর বেগম। তিনি সাভারের ইপিজেড এলাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন। তাঁর একার সামান্য উপার্জনেই চলে চারজনের সংসার। কিন্তু দুর্যোগ তাঁদের পিছু ছাড়ে না। ২০১৬ সালে মুক্তামণি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে, বাড়ির পাশে খেলা করার সময় বিদ্যুতের তারে স্পৃষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হয়। পরে তার কনুই থেকে দুই হাত কেটে ফেলতে হয়। এক বছর সে স্কুলে যেতে পারেনি। পরে মুক্তামণি হিজলায় দাদাবাড়িতে যায় এবং বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
পিইসিতে জিপিএ-৫ পেলেও হাসি নেই মুক্তামণি ও তার পরিবারের। তার মায়ের আয়ে দুবেলা ভাত জোটানোই দায়। তার ওপরে পড়াশোনার ব্যয় মেটানো দুরূহ।
মুক্তামণির মা ঝুমুর বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘মেয়েটা ভালো রেজাল্ট করেছে। সবাই খুশি হয়ে বাহবা দেয়। মা হয়ে আমারও খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু কীভাবে খুশি হব? ছোট্ট মেয়েটার কষ্ট, শ্রম ও ভালো ফল দেখে আমার কলিজাটা পুড়ে যাচ্ছে। ভালো ফল করায় আমার মাথার ওপরে যেন বড় একটা পাথর চাপা দিয়েছে। আমাদের জীবনে এত দুর্যোগ কীভাবে সামলাব। সংসারের খরচ জোটাব না মেয়েটাকে পড়াব। কী দিয়ে কী করব, কিছুই ভাবতে পারছি না।’
ঝুমুর বেগম জানান, দাদা-দাদির কাছে থেকেই পড়াশোনা শুরু করেছিল মুক্তামণি। দাদি ওকে দেখাশোনা করত। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য। গত ২৭ ডিসেম্বর ওর দাদি আকস্মিক মারা গেছেন।
ভালো ফল করায় খুশি কি না—জানতে চাইলে মুক্তা ফ্যাল ফ্যাল করে মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। মলিন মুখে বলল, ‘খুশি।’ বোঝা গেল পরিবার আর নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এতটুকু মেয়েটা গভীর অনিশ্চয়তায় ঘুরপাক খাচ্ছে। একটু থেমে সে বলল, ‘মা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। মাকে আর কত কষ্ট দিব। আর কত কষ্ট করবেন আমার মা। বড় হয়ে আমার শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা। জানি না অত দূর যেতে পারব কি না।’
পূর্ব পত্তণীভাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোসাম্মৎ নাছিমা খানম বলেন, অভাব আর প্রতিবন্ধিতাকে জয় করে মুক্তামণি যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা অন্যদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। বিদ্যালয় থেকে এবার ১৪ জন পরীক্ষার্থী পিএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের মধ্যে মুক্তামণি পা দিয়ে লিখে একাই জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে এখন ওই গ্রামের দৃষ্টান্ত।
নাছিমা খানম আরও বলেন, মুক্তামণির এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা অর্থনৈতিক সংকট। এখন তার সহায়তা প্রয়োজন। সরকারিভাবে বা সমাজের কোনো বিত্তবান ব্যক্তি এগিয়ে এলে মুক্তামণি এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারবে।