প্রতিযোগিতার জন্য পায়রাগুলোকে ছোট থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রথমে চেনানো হয় বাড়ি। এ সময় খাঁচায় করে এদের বাড়ির সামনে কিছুদিন রাখা হয়। এর পরের ধাপে মাস তিনেক ওড়ানো হয় বাড়ির ওপর। এরপর ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে ছাড়া হয়। পায়রাগুলো বাড়ি চিনতে পেরেছে কি না, চলে সেই পরীক্ষা। চিনতে পারলে ঠিক চলে আসে। এরপর ২০ কিলোমিটার, ৩০ কিলোমিটার, এ রকম করে দূরত্ব বাড়ানো হয়। এভাবে ২০১৯ ও ২০২০ সালে আয়োজন করা হয় ২০০ কিলোমিটারের রেস প্রতিযোগিতা। জয়ী পায়রার মালিককে দেওয়া হয় অর্থ পুরস্কার।
এই প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার শুধু যে বিনোদনের উৎস তা নয়, পাশাপাশি পায়রা ব্যবসায় মানুষকে উৎসাহিতও করে তোলে। মৌলভীবাজারের বড়লেখার পায়রার মাধ্যমে বিনোদন ও উপার্জনের পথ তৈরি করার বড় উদ্যোক্তা হলেন আনোয়ার হোসেন (৪০)। তাঁর সাফল্য দেখে এলাকার অনেকেই এ ব্যবসায় এসেছেন।
এই উদ্যোগ এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো উপজেলায়। তাঁর কাছ থেকে পায়রা কিনে ও পরামর্শ নিয়ে অন্তত ১২টি বড় খামার হয়েছে। সিলেট ও মৌলভীবাজারের অনেক জায়গা থেকে লোকজন এসে সরাসরি তাঁর কাছ থেকে পায়রা কিনে নেন। অনলাইনেও বিক্রি করেন।
এইচএসসি পর্যন্ত পড়েই পারিবারিক বেকারি ব্যবসায় যুক্ত হন আনোয়ার হোসেন। কিন্তু তাঁর মন পড়েছিল অন্য কোথাও। শৈশব থেকে দেশি পায়রা পুষতেন। সেই পায়রাই যে তাঁর ভবিষ্যৎ আয়ের অবলম্বন হবে, সেটা ভাবেননি।
২০১৪ সালে সংগ্রহ করলেন চার জোড়া গিরিবাজ কবুতর। বছর পার না হতেই ডিম ফুটে ছানা হলো, ছানাদের ছানা হলো।Ñএভাবে পায়রার সংখ্যা দাঁড়াল ৩২ জোড়ায়। এরপর আধপাকা একটি ঘর তুললেন। ঢাকা ও সিলেট থেকে হাই ফ্লাইয়ার ও রেসার জাতের কবুতর সংগ্রহ করলেন। খামারে জড়ো করলেন ২০ জাতের কবুতর। সেই বছরই ঘর বানানো ও পায়রা কেনায় বিনিয়োগ করেন আড়াই লাখ টাকা। বড়লেখার পানিধারে গড়ে তোলেন তাঁর পায়রার খামার।
এখন তাঁর খামারে ২৫ জাতের প্রায় আড়াই শ পায়রা। এর মধ্যে রয়েছে গিরিবাজ, পাকিস্তানি টেডি, ইন্ডিয়ান কালদম, পাংখি, চিলা, সবুজ গলা, জিরা গলা, কালপিট, ঘিয়াচুল্লি, সুয়াচন্দন, ব্লু রেসার, মাক্সি রেসার ইত্যাদি। এগুলোর জোড়া কোনো কোনোটি ১ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। খামারে প্রায় ছয় লাখ টাকার পায়রা আছে।
আনোয়ার হোসেন যে শুধু নিজেই ব্যবসা করছেন, তা নয়। এই উদ্যোগ এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো উপজেলায়। তাঁর কাছ থেকে পায়রা কিনে ও পরামর্শ নিয়ে অন্তত ১২টি বড় খামার হয়েছে। সিলেট ও মৌলভীবাজারের অনেক জায়গা থেকে লোকজন এসে সরাসরি তাঁর কাছ থেকে পায়রা কিনে নেন। অনলাইনেও বিক্রি করেন। প্রতি মাসে তাঁর আয় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। পারিবারিক ব্যবসার আয়ের পাশাপাশি এ বাড়তি উপার্জন তাঁর সংসারে এনেছে সচ্ছলতা। তিন মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ভালোই চলে তাঁর সংসার।
পাখির পেছনে খরচ কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, খরচ বলতে খাবার। দেখাশোনার জন্য একজন লোক রাখা হয়েছে। সকাল ও বিকেলে দুই ঘণ্টা করে কবুতরগুলোকে খাবার, পানি খাওয়ানো এবং থাকার স্থানটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হয়।
পায়রার রোগবালাই হলে নিজেই চিকিৎসা করেন আনোয়ার হোসেন। পায়রার রোগবালাই, প্রতিকার ও লালনপালন সম্পর্কে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে সাত দিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর আগে পরামর্শ নিতেন স্থানীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছ থেকে। শীতের সময় ঠান্ডা লাগার ভয় থাকে। তখন একটু সতর্ক থাকতে হয়।
অল্প পুঁজি, অল্প শ্রম দিয়ে ভালো উপার্জনের সহজ পথ এটি। তিনি বলেন, মাদক নয়, অপরাধ নয়, পায়রা পুষেই বেকার যুবকেরা নিজের হাতখরচের টাকা জোগাড় করতে পারেন।আনোয়ার হোসেন
আনোয়ার হোসেন মনে করেন, অল্প পুঁজি, অল্প শ্রম দিয়ে ভালো উপার্জনের সহজ পথ এটি। তিনি বলেন, মাদক নয়, অপরাধ নয়, পায়রা পুষেই বেকার যুবকেরা নিজের হাতখরচের টাকা জোগাড় করতে পারেন। চাইলে যেতে পারেন আরও দূর। প্রয়োজনে তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চান। সেই সঙ্গে বিনোদনও খুঁজে নেন এই পায়রাতেই। গড়ে তোলেন ‘বড়লেখা পিজিয়ন অ্যাসোসিয়েশন’। সদস্যসংখ্যা ৭০। তিনি সাধারণ সম্পাদক। এই সংগঠনের মাধ্যমে আয়োজন করেন কবুতরের রেস প্রতিযোগিতা।
এ পর্যন্ত দুবার ২০০ কিলোমিটারের রেস প্রতিযোগিতা হয়েছে। ২০১৯ সালে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী সবাই ছিলেন বড়লেখার। তাঁরা একই গাড়িতে করে পায়রা নিয়ে কুমিল্লার লাকসামে যান। সেখান থেকে পায়রা ছাড়েন। প্রথম পায়রাটি তিন ঘণ্টায় মালিকের বাড়িতে উড়ে এসেছে। দু–একটি বাজপাখির কবলে পড়ে পথ হারিয়েছে। বাকিগুলো ফিরে এসেছে যার যার ডেরায়।
আর গত বছরের প্রতিযোগিতাটি হয়েছে কিশোরগঞ্জের ভৈরব সেতু থেকে। বড়লেখার সব প্রতিযোগী পায়রা নিয়ে ভৈরব সেতুতে যান। সেখান থেকে পায়রা ছেড়ে দিলে পায়রাগুলো যার যার বাড়িতে ফিরে এসেছে। এবার আরও একটি রেস হওয়ার কথা।
অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে সেই প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ চলছে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী পায়রার মালিককে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়, যাতে তাঁর ব্যবসা বাড়তে পারে। এ ছাড়া গিরিবাজ পায়রা ওড়ানোর প্রতিযোগিতাও হয়। এই পায়রারা বাড়ির ওপর টানা আট ঘণ্টা পর্যন্ত উড়তে পারে। যেটি বেশি সময় উড়তে পারে, সেটিকে পুরস্কৃত করা হয়।
সম্প্রতি আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুবকেরা বেকার থাকলে অনেকে অর্থনৈতিক সংকটে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এদের উৎসাহিত করতে আমরা প্রতিযোগিতা করি। যাতে কবুতরের মালিকেরা বিনোদন পান। পাশাপাশি খামার গড়তে আগ্রহ বাড়ে। কবুতর পালন করলে আয়ের সঙ্গে সময়ও ভালো কাটে।’
আনোয়ারের কাছ থেকে উৎসাহিত হয়ে উপজেলার পশ্চিম গগড়া গ্রামের রিপন দাস গড়ে তুলেছেন খামার। তিনি বলেন, ‘আমার ১০০টি দেশি পায়রা আছে। রোগবালাই হলে তাঁর (আনোয়ার) কাছ থেকে পরামর্শ নিই। কম পরিশ্রমে এটি একটি লাভজনক উদ্যোগ। ভালো লাগার বিষয়ও।’
বড়লেখার সহকারী যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা পুর্নেন্দু কুমার দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, আনোয়ার হোসেন একজন উদ্যোগী যুবক। শুরুতে কিছু সমস্যা হলেও প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আর কোনো সমস্যা হয়নি। তাঁর দেখাদেখি গোটা উপজেলায় ৭০ থেকে ৮০ জন কবুতর পালন করছেন। তাঁর কাছ থেকে তাঁরা বাচ্চা নিচ্ছেন, পরামর্শ নিচ্ছেন। অনেক বেকার যুবক এখন মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা উপার্জন করছেন।