করোনায় চরম আর্থিক সংকট থেকে বাঁচার দাবিতে সিলেটের জাফলংয়ে ইসিএর বাইরে পাথর উত্তোলনের দাবিতে মিছিল–সমাবেশ। জাফলংয়ের মামার দোকান এলাকায় আজ মঙ্গলবার বিকেলে
করোনায় চরম আর্থিক সংকট থেকে বাঁচার দাবিতে সিলেটের জাফলংয়ে ইসিএর বাইরে পাথর উত্তোলনের দাবিতে মিছিল–সমাবেশ। জাফলংয়ের মামার দোকান এলাকায় আজ মঙ্গলবার বিকেলে

পাথর কোয়ারি খুলে না দিলে আন্দোলনের হুমকি

করোনা পরিস্থিতির আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সব পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে ‘বৃহত্তর সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ’। জাফলংয়ের শ্রমিক পরিবারগুলোকে বাঁচাতে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) বাইরে তাঁরা পাথর উত্তোলনের অনুমতি দাবি করেছেন। পাথর কোয়ারি খুলে না দিলে আগামী ১ ডিসেম্বর সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা মানববন্ধন করে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণার হুমকি দিয়েছেন।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে জাফলংয়ের মামারবাজার এলাকায় সমাবেশ করে এ দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। সমাবেশে শ্রমিক-ব্যবসায়ীরা বলেন, করোনা পরিস্থিতির কথা বলে সিলেটের সব কটি পাথর কোয়ারি বন্ধ রাখায় সিলেট অঞ্চলের ৫ উপজেলার ১০ লাখ লোক বেকার ও কর্মহীন কাটাচ্ছেন। এ অবস্থায় নীরব দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছে পাঁচ উপজেলার শ্রমজীবী পরিবারগুলোতে। পাথর কোয়ারি খুলে না দিলে পাথরশ্রমিক পরিবারগুলো না খেয়ে মারা যাবে।

করোনা পরিস্থিতির কথা বলে সিলেটের সব কটি পাথর কোয়ারি বন্ধ রাখায় সিলেট অঞ্চলের ৫ উপজেলার ১০ লাখ লোক বেকার ও কর্মহীন কাটাচ্ছেন। এ অবস্থায় নীরব দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছে পাঁচ উপজেলার শ্রমজীবী পরিবারগুলোতে।

সমাবেশ থেকে বলা হয়, সিলেটের ১০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহের পথ পাথর কোয়ারি থেকে পাথর আহরণ। জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ, লোভাছড়া, উৎমা, শ্রীপুর পাথর কোয়ারি থেকে যুগ যুগ ধরে পাথর আহরণের মাধ্যমে লাখো মানুষের জীবন-জীবিকা চলছে। করোনা পরিস্থিতির কথা বলা হলেও পাথর কোয়ারি বন্ধ করা হয়েছে দেশের বাইরে থেকে পাথর আমদানিতে একটি ‘মাফিয়া সিন্ডিকেটকে’ সুযোগ করে দিতে। ওই সিন্ডিকেটের তৎপরতায় পাথর কোয়ারি বন্ধ করার ‘গণবিরোধী’ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এতে করোনাকালে শ্রমিকেরা ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ না পেয়ে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন। শ্রমিক-ব্যবসায়ীদের ঘরে ঘরে এখন দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি।

করোনায় চরম আর্থিক সংকট থেকে বাঁচার দাবিতে সিলেটের জাফলংয়ে ইসিএর বাইরে পাথর উত্তোলনের দাবিতে সমাবেশ। জাফলংয়ের মামার দোকান এলাকায় আজ মঙ্গলবার বিকেলে

বক্তারা আরও বলেন, পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের প্রাচীন জীবিকা বন্ধ হয়েছে। এতে অর্থনৈতিকভাবেও হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের কর্মহারা পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে জাফলংয়ে ইসিএ এলাকা ছাড়া অন্যান্য এলাকায় পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর আহরণ করার সুযোগ দিতে হবে। অন্যথায় ১ ডিসেম্বর মানববন্ধন করে টানা আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

বৃহত্তর সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ এর আগে ১২ নভেম্বর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় সমাবেশ করে ভোলাগঞ্জ ও উৎমা পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে জাফলংয়ে এই সমাবেশ হলো।

পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক আবদুল জলিলের সভাপতিত্বে ও পাথর ব্যবসায়ী সাব্বির আহমদের সঞ্চালনায় আজকের সমাবেশে বক্তব্য দেন সিলেট বিভাগীয় ট্রাক মালিক গ্রুপের সভাপতি গোলাম হাদী ছয়ফুল, জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু সরকার, ব্যবসায়ী শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্যসচিব মো. নুরুল আমিন, সিলেট বিভাগীয় ট্রাক-পিকআপ ও কাভার্ড ভ্যান মালিক ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক, মৌলভীবাজার ট্রাক, ট্যাংকলরি ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি মো. রশিদ উদ্দিন আহমদ, জেলা সিএনজিচালিত অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ জাকারিয়া, সিলেট বিভাগীয় ট্রাক-পিকআপ ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আবদাল মিয়া, পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা লুৎফুর রহমান, জৈন্তাপুর ইউপির চেয়ারম্যান এখলাছুর রহমান, গোয়াইনঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম, জাফলং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মিনহাজুর রহমান, গোয়াইনঘাট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারোয়ার, জাফলং স্টোন ক্রাশার মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াছ উদ্দিন, ছাতক পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জয়নাল চৌধুরী, ছাতক পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাই, ধোপাগুল স্টোন ক্রাশার মালিক সমিতির সভাপতি হাজি নাসির উদ্দিন প্রমুখ।

পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় সিলেটের জাফলংয়ে জমেছে নতুন পাথরের স্তূপ। সম্প্রতি তোলা

এদিকে জাফলংয়ে ইসিএর বাইরে পাথর উত্তোলনের দাবি প্রসঙ্গে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজমুস সাকিব প্রথম আলোকে বলেন, পাথর উত্তোলনের বিষয়টি উপজেলা প্রশাসনের একক সিদ্ধান্তের মধ্যে নেই। দাবির বিষয়টি পাথর কোয়ারি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোসহ সংশ্লিষ্টদের নজরে আনা হবে।

গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জাফলংয়ের ১৮৮ দশমিক ৭০ হেক্টর জায়গা পাথর কোয়ারি (পাথর উত্তোলনস্থল) চিহ্নিত করে ইজারা-ব্যবস্থার মাধ্যমে ১৯৮০ সাল থেকে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। শুরুতে সনাতন পদ্ধতিতে এ কাজ চললেও দেড় দশক ধরে শুরু হয় যন্ত্র ব্যবহার। এর মধ্যে মাটির গভীর থেকে পাথর উত্তোলনে ব্যবহার করা হয় ‘বোমা মেশিন’সহ খননযন্ত্র। পাথর উত্তোলনে যন্ত্রনির্ভরতা জাফলংকে সংকটাপন্ন করে তোলে। এ পরিস্থিতিতে ২০১২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় জাফলংকে ইসিএ ঘোষণার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাফলংকে ইসিএ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়।

ইসিএ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে সারি-গোয়াইনঘাট নদীর সংযোগস্থল পর্যন্ত প্রবহমান জাফলং-ডাউকি নদী পরিবেশগত সংকটাপন্ন। গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁও ও পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের ১১টি মৌজা নিয়ে মোট ১৪ দশমিক ৯৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা ইসিএ। ঘোষিত এলাকার মধ্যে জাফলং-ডাউকি নদী এবং এ নদীর উভয় পাড় থেকে ৫০০ মিটার এলাকাসহ বল্লাঘাটের বিপরীত দিকে পিয়াইন নদ পর্যন্ত বিস্তৃত পুরো খাসিয়াপুঞ্জি রয়েছে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী পাথর উত্তোলন কার্যক্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে ইসিএ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রতিবেশ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চালাতে বলা হয়েছে।