খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার দুর্গম গ্রাম বড় ত্রিপুরাপাড়ার লোকজন নিজেরাই গ্রামের পরিবেশ রক্ষা করেন
খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ডাকবাংলা বাজার। যেতে হয় পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে। ডাকবাংলা বাজার থেকে মোটরসাইকেল কিংবা হেঁটে ছয় কিলোমিটার দূরে বড় ত্রিপুরাপাড়া। শান্ত, সবুজ পাহাড়ঘেরা গ্রাম। গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট ছড়া—তৈকালাং। এতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বড় বড় প্রাকৃতিক পাথর। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় সময় ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন পাথর কিনতে। কিন্তু পাথরে কাউকে হাত দিতে দেন না পাড়াবাসী। এই পাথর আগলে বাঁচতে চান তাঁরা। এমনকি পাহাড়ের কোনো গাছও কাটা নিষেধ এ গ্রামে।
গত বৃহস্পতিবার যখন বড় ত্রিপুরাপাড়ায় পৌঁছাই তখন দুপুর। এটি পড়েছে উপজেলার বর্ণাল ইউনিয়নে। গ্রামের ঢোকার মুখেই আমাদের পথ রোধ করেন পাড়াবাসী কয়েকজন পুরুষ। শুরু হয় জেরা—কেন এখানে এসেছি, কী কাজ, এসব। পরিচয় দেওয়ার পর অমল ত্রিপুরা নামের একজন বললেন, ‘স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পরিচয় না দিয়ে পাথর কেনার জন্য গ্রামে ঢুকতে চান। টাকাপয়সার লোভ দেখান। আমরা না বলে দিই। তাই এখন কেউ এলে আগে পরিচয় জানতে চাই।’
গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে মনজুড়ানো দৃশ্য। তৈকালাং ছড়ার দুই পাড়ে ছোট ছোট টিলায় বসতি। ছড়ায় যত দূর চোখ যায়, পাথর আর পাথর। পাহাড় থেকে নেমে পানি পাথরগুলোকে ছুঁয়ে বয়ে চলেছে। এই পানিতে নেমেই গোসল করছেন গ্রামবাসী। দু-একজন আবার মাছ ধরছেন। ছড়ার দুই পাশে দেখা গেল বেশ কিছু কুয়া। পাথরের ওপর থেকে নেমে আসা পানি জমা হচ্ছে কুয়াগুলোতে। ছেলেমেয়েরা কলস আর বোতলে ভরে ঘরে নিয়ে যাচ্ছে এই পানি। এই পানি তারা পান করে।
গ্রামবাসী বলেন, গ্রামের লোকজন কখনো একটি পাথরও বিক্রি করেননি। তাঁদের বিশ্বাস, পাথরগুলোর প্রাণ আছে। ছোট পাথরগুলোও ধীরে ধীরে বড় হয়ে পানির উৎস ধরে রাখে। এতে লুকিয়ে আছেন দেবতা। গ্রামবাসী যদি পাথর বিক্রি করেন, তাহলে দেবতা রুষ্ট হবেন। পাথরের কারণে এখন পর্যন্ত গ্রামে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়নি। শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট হয় না। এই পাথর বিক্রি হলে বিলীন হবে তৈকালাং ছড়ার দুই কূলের বসতি। নষ্ট হবে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
কূপের পাশে পাওয়া গেল গ্রামের বাসিন্দা ও কলেজশিক্ষার্থী রিয়া ত্রিপুরা ও রমেশ ত্রিপুরাকে। তাঁরা বলেন, ‘গ্রামের পরিবেশ ধরে রাখতে আমরা সব সময় সতর্ক। অপরিচিত লোকজনকে আমরা গ্রামের ভেতরে যেতে দিই না।’
গ্রামের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী সপিলতা ত্রিপুরা বলেন, ‘এলাকার অধিকাংশ পরিবার কৃষি ও জুমচাষের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে এলাকার ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন স্কুল–কলেজে পড়ালেখা করছে। পাথরগুলো থাকায় আমাদের গ্রামটা অনেক সুন্দর।’
পাড়ার বাসিন্দা ও হেডম্যান কেতকী মোহন ত্রিপুরা বলেন, ‘চারটি ছোট পাহাড় ঘিরে প্রায় ১০০ একর জায়গাজুড়ে এখানে ১৮০টি পরিবার বসবাস করে। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে একবার গাড়ি নিয়ে এসে পাথর নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন গ্রামবাসী তাদের রুখে দেন। সেই থেকে গ্রামবাসী অনেক বেশি সজাগ পরিবেশ নিয়ে।’
কেতকী মোহন ত্রিপুরা বলেন, ‘পাথর থাকলে পানির উৎস থাকবে, ভূমি ক্ষয় হবে না। পাথর সরানো হলে পাহাড় ধসে পড়বে। এগুলোও আমাদের কাছে সন্তানের মতো।’
কথায় কথায় সময় গড়ায়। আমরাও ফেরার পথ ধরি। তখন সূর্যও হেলে পড়েছে। ফেরার পথে দেখা হয় কয়েকজন কলেজ শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তাঁরা এসেছেন চার কিলোমিটার দূর থলিপাড়া থেকে। ওই দলের মংচিং মারমা ও ক্যচিংহøমারমা বলেন, এমন পাথর দেখে তাঁরা মুগ্ধ। এই পাড়ায় সময় কাটাতে তাঁদের বেশ ভালোই লাগে। গ্রামের লোকজন যে পরিবেশের কথা চিন্তা করে যুগ যুগ ধরে পাথর, আদি গাছ সংরক্ষণ করতে পারেন, বড় ত্রিপুরা পাড়া তার দৃষ্টান্ত। সবাইকে তাঁদের পথে চলা উচিত।