কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় তিনজনকে আসামি করে আদালতে মামলা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে কিশোরগঞ্জ আদালতে মামলাটি করেন। আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহম্মাদ আবদুন নূর দ্রুত বিচার আইনে আরজিটি আমলে নেন।
গত মঙ্গলবার বিকেলে জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া এলাকায় এই হামলার ঘটনা ঘটে। মামলার আসামিরা হলেন কটিয়াদীর মসূয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি জাকির হোসেন, পাকুন্দিয়ার বুরুদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান নাজমুল হুদা ও শালুয়াদী গ্রামের আতাউর রহমানের ছেলে রুবেল মিয়া। রুবেল ও নাজমুল স্থানীয়ভাবে যুবলীগের সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচিত।
রফিকুল ইসলাম পাকুন্দিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়কও। দলীয় সমর্থন নিয়ে তিনি এবার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হন। এর আগে আরও এক মেয়াদে চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
মামলার এজাহারে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রয়োজনে মঙ্গলবার বিকেল রফিকুল শালুয়াদী গ্রামে ছিলেন। ফেরার পথে বাদ আসর মসূয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের দুই প্রয়াত নেতার আত্মার শান্তির জন্য আয়োজিত মিলাদ দেখতে পান। মসূয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ওই মিলাদের আয়োজন করে। কিছুদিন আগে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন কটিয়াদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহাব। তিনি কটিয়াদী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। প্রয়াত আবদুল ওয়াহাব ও আলাউদ্দিন ভাসানীর নামে স্থানীয় আওয়ামী লীগের আরেকজন নেতার জন্য ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের মিলাদে আয়োজনে শামিল হন রফিকুলও। মিলাদে রফিকুলের উপস্থিতি টের পাওয়ার পর যুবলীগ নেতা জাকির হোসেন তাঁর উদ্দেশে গালমন্দ শুরু করেন। পরে জাকির হোসেনের নেতৃত্বে অনুষ্ঠানস্থলের কাছে থাকা তাঁর সরকারি গাড়িটিতে ভাঙচুর চালানো হয়। দা, বল্লম ও লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলায় অংশ নেয় ১৫ থেকে ২০ জন। এই সময় তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। পরে কটিয়াদীর বনগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান কামাল হোসেনের সহযোগিতায় ঘটনাস্থল ছাড়েন রফিকুল। জাকির হোসেনের সঙ্গে হামলার ইন্ধনে ছিলেন নাজমুল হুদা ও রুবেল মিয়া।
আমি মূলত নিজ দলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলের শিকার। পাকুন্দিয়া ও কটিয়াদী একই নির্বাচনী এলাকা হলেও কটিয়াদীতে আসতে আমার মানা। কেন এলাম, মূলত সেই কারণে আক্রোশের শিকার হতে হয়েছে।রফিকুল ইসলাম, পাকুন্দিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, ঘটনার পরদিন রফিকুল থানায় যান। তবে সেখানে গিয়ে পুলিশের সহযোগিতা পাননি। এ জন্য তিনি আদালতের আশ্রয় নিয়ে মামলা করছেন।
রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মূলত নিজ দলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলের শিকার। পাকুন্দিয়া ও কটিয়াদী একই নির্বাচনী এলাকা হলেও কটিয়াদীতে আসতে আমার মানা। কেন এলাম, মূলত সেই কারণে আক্রোশের শিকার হতে হয়েছে।’
প্রধান আসামি জাকির হোসেনের বক্তব্য জানতে তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোনে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে ফোন দেওয়া হয়। রিং হলেও ফোনটি ধরেননি তিনি।
হামলার বিষয়ে মসূয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি হামিদুল হক বলেন, তাঁদের আয়োজনে রফিকুল ইসলাম আমন্ত্রিত ছিলেন না। রফিকুলকে নিয়ে দলে বিভক্তি আছে। সেই কারণে তাঁকে দেখার পর কেউ কেউ সহজে মেনে নিতে পারেননি।
আমাদের আয়োজনে রফিকুল ইসলাম আমন্ত্রিত ছিলেন না। রফিকুলকে নিয়ে দলে বিভক্তি আছে। সেই কারণে তাঁকে দেখার পর কেউ কেউ সহজে মেনে নিতে পারেননি।হামিদুল হক, মসূয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি
এদিকে ঘটনাটির পেছনে কিশোরগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদের সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুলের বিরোধ নেপথ্য কারণ হিসেবে কাজ করেছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন। সূত্রমতে, কটিয়াদী ও পাকুন্দিয়া উপজেলা নিয়ে কিশোরগঞ্জ-২ সংসদীয় আসন। রফিকুল পাকুন্দিয়া আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। দলীয় সমর্থন নিয়ে তিনি এবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। এর আগে আরও এক মেয়াদে চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। এই আসনের সাংসদ নূর মোহাম্মদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং দলীয় সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করে সাংসদ নির্বাচিত হন। নূর মোহাম্মদ রাজনীতিতে আসার পর থেকে রফিকুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু করোনার শুরুর দিকে সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার নেতৃত্ব নিয়ে সাংসদের সঙ্গে চেয়ারম্যানের দূরত্ব বাড়ে। বর্তমান রফিকুলকে সাংসদের প্রতিপক্ষ হিসেবে ভাবা হয়।
এই অবস্থায় গেল বছরের ৬ আগস্ট রফিকুল চেয়ারম্যান পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হন। পৌর মেয়র, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও সব ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানদের অনাস্থা প্রস্তাবের কারণে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে রফিকুলের বিরুদ্ধে এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এসব ঘটনার সূত্র ধরে গেল বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর দলীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে রফিকুল পক্ষের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ১০ জন আহত এবং যানবাহন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ১৫ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতের রায়ে তিনি স্বপদে বহাল হন।
থানায় মামলা না নেওয়ার বিষয়ে কটিয়াদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম এ জলিল বলেন, থানা ভবন সিসিটিভি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রিত। রফিকুল এলে ক্যামেরায় থাকতেন। দুই দিনের ফুটেজ বিশ্লেষণ করলে কোথাও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আদালতে মামলা হওয়ার বিষয়ে শুনেছেন এবং ঘটনার দিন ঘটনাস্থলেও গেছেন বলে জানান। ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁর কাছে মনে হয়েছে, ওই দিন যা হয়েছে, সবই নিজ দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে হয়েছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে গাড়িটি পাননি বলে ভাঙচুর হয়েছে কি না, তা তিনি নিশ্চিত নন।
এর আগে ওসি প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তাঁর ধারণা, ঘটনাটি সাজানো হতে পারে।