অবশেষে সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে কেজিপ্রতি ৫ টাকা কমে চিনি বিক্রি শুরু করেছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থা (বিএসএফআইসি)। দেশের সরকারি চিনিকলগুলোর শ্রমিক-কর্মচারী ও আখচাষিদের বকেয়া পাওনা পরিশোধে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে অবস্থিত রংপুর চিনিকল লিমিটেডের শ্রমিক-কর্মচারী ও কৃষকদের পাওনা মোট ১৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। চিনি বিক্রির এই টাকা দিয়ে অন্যান্য চিনিকলের মতো এই চিনিকলের পাওনা পরিশোধ করা হবে। গতকাল শুক্রবার বিকেলে রংপুর চিনিকল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন আকন্দ এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘চলতি মাসের মাঝামাঝিতে সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়। এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে ১০ হাজার মেট্রিক টন চিনি বিক্রি হয়েছে বলে শুনেছি।’
রংপুর চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, চিনিকলে শ্রমিক-কর্মচারী ও কৃষকদের ১৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে আখ সরবরাহ বাবদ কৃষকের পাওনা রয়েছে ৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং বেতন-ভাতা বাবদ শ্রমিক-কর্মচারীদের পাওনা রয়েছে ৬ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ মাড়াই মৌসুমের আখমাড়াই গত বছরের ৭ ডিসেম্বর শুরু হয়। চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাড়াই কার্যক্রম চলে। মাত্র ৭০ দিনে ৫৬ হাজার ২৬৩ মেট্রিক টন আখমাড়াই করা হয়। এই পরিমাণ আখ থেকে চিনি উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ২৪৩ মেট্রিক টন। এ মৌসুমে আখচাষিরা আটটি ক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে ১৮ কোটি ২৫ লাখ টাকার আখ চিনিকলে সরবরাহ করেন। এর মধ্যে দুই দফায় ৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। অবশিষ্ট ৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এখনো পরিশোধ করা যায়নি। ফলে কৃষকেরা হতাশ হয়ে পড়েছেন।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের পুনতাইর গ্রামের কৃষক জহুরুল হক বলেন, এ মৌসুমে চিনিকলে ৫০ হাজার টাকার আখ বিক্রি করেন তিনি। কিন্তু চিনিকলে মাড়াই বন্ধ হলেও টাকা পাননি। অথচ এই টাকা দিয়ে আসন্ন রমজান ও ঈদের জন্য খরচ করতে চেয়েছিলেন।
একই গ্রামের কৃষক আলমগীর মিয়া বলেন, জমির ফসল ছাড়া কৃষকদের বাড়তি আয়ের সুযোগ নেই। তাঁরা ধান দিয়ে খাদ্যের চাহিদা মেটান। আর আখ বিক্রি করে সংসারের দায়দেনা মেটান। চিনিকলের কাছে তিনি ৩৫ হাজার টাকা পান। এখনো টাকা পাননি।
এদিকে গত বছরের নভেম্বর থেকে ৭৮৭ জন শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ৫ মাসের ৬ কোটি টাকা বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে। টাকার অভাবে নভেম্বর মাসের পর বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়নি। ফলে চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এসব কারণে চিনিকলের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে।
চিনিকল কর্তৃপক্ষ বলছে, রংপুর চিনিকলে উৎপাদিত চিনি বিক্রি না হওয়ায় টাকার অভাবে শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা এবং আখচাষিদের পাওনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। রংপুর চিনিকলের গুদামে সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন চিনি অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে। যার মূল্য প্রায় ২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর কারণ বেসরকারি চিনিকলগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে ‘র সুগার’ এনে চিনি উৎপাদন করছে। এতে উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় তারা বাজারে কম দামে চিনি বিক্রি করছে। কিন্তু সরকারি চিনিকলগুলোতে আখ থেকে চিনি উৎপাদন করা হয়। এতে খরচ বেশি পড়ছে। ফলে সরকারি চিনিকলগুলো বেসরকারি চিনিকলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
চিনিকল সূত্র জানায়, সরকারি চিনিকলে প্রতি কেজি চিনির দাম ৫০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অপর দিকে বেসরকারি চিনিকলের উৎপাদিত চিনি প্রতি কেজি ৪৫ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এ কারণে ডিলাররা সরকারি চিনিকল থেকে চিনি উত্তোলন করছেন না।
রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন আকন্দ বলেন, বিএসএফআইসির অধীন চিনিকলগুলোতে মজুত থাকা চিনি ছাড়াও সরকার ১ লাখ মেট্রিক টন চিনি আমদানি করে। আমদানি করা এই চিনির মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। কেজিপ্রতি ৫ টাকা কম দামে চিনি বিক্রি শুরু হয়েছে। বিক্রি শেষ হলেই আসন্ন রমজানের আগেই কৃষকদের ও শ্রমিক-কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের বকেয়া পাওনা পরিশোধ করা হবে।